সাতসতেরো

পর্যটকশূন্য কুয়াকাটার কান্না

‘এমন খারাপ অবস্থা জীবনে কখনও আসে নাই। সারাদিন হাজার টাকা কামাই হইতো, এখন একশ টাকাও হয় না। কিনবে কে? মানুষই তো নাই!’ বলছিলেন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ঝালমুড়ি বিক্রেতা হেলাল পেয়াদা।

বয়স কত হবে? আনুমানিক পঞ্চাশ। এই জীবনে দুঃখ, কষ্ট অনেক সয়েছেন কিন্তু এমন দুর্দিনে কখনও পড়েননি। নিজেই বললেন, স্থানীয়রা তার ঝালমুড়ি এখন আর খায় না করোনার ভয়ে! কুয়াকাটায় পর্যটক আসা বন্ধ হয়েছে গত মার্চে। এরপর থেকেই তার জীবনে দুর্দিনের শুরু।  

ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৯টা। মাথার উপরের বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ঝুলে থাকা হলুদ আলোর নিচে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। পাশেই এক ঝাকা মুড়ি। কাটা পেঁয়াজ, মরিচ, তেল, লবণসহ হরেক রকমের অনুষঙ্গ মুড়ির চারপাশে সাজানো। বোঝা গেল, প্রস্তুত হয়েই তিনি বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে। কিন্তু খুব কম মানুষই এখন সৈকতে আসেন। যারা আসেন তারাও স্থানীয়। তাই ক্রেতার অভাবে ঝালমুড়ি বিক্রি হয় না তেমন। নির্বাক চাতকের মতো হেলাল পেয়াদা দাঁড়িয়ে থাকেন ক্রেতার আশায়। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামে সৈকতে, তার অপেক্ষা ফুরায় না।

কথা বলে জানা গেল, প্রতিদিন আশাহত হয়ে শূন্য পকেটেই ঘরে ফিরতে হয় তাকে। এদিকে ছয় সদস্যের পরিবারের কর্তা তিনি। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা তো দূরের কথা, কীভাবে এখন সংসার চলবে হেলালের জানা নেই। এমন অবস্থা তার একার নয়, সৈকতের চা বিক্রেতা, ডাব বিক্রেতা, হকার, চটপটি, ফুচকা বিক্রেতারাও পড়েছেন চরম সংকটে। কুয়াকাটার শত-শত নিম্ন আয়ের মানুষ এখন কঠিন অভাবের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। 

সৈকতের ফুচকা, চটপটি বিক্রি করেন রবিন (২৮)। ৮ বছর ধরে এই কাজ করছেন তিনি। ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু করোনার কারণে এখন আর দোকান খুলতে পারছেন না। খুলেই বা লাভ কী? ফলে অন্য কাজের খোঁজ করছেন তিনি। রবিন জানালেন, কুয়াকাটায় মোট ৩২টি ফুসকা, চটপটির দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি এখন বন্ধ। পর্যটক নেই বলে স্থানীয়রাই এখন ক্রেতা। প্রতিদিন গড়ে একশ টাকাও বিক্রি হয় না। ফলে রবিন জানেন না, সামনের দিনগুলোতে তার কপালে কি লেখা আছে!

পর্যটন-নির্ভর এতো দিন যারা ব্যবসা করে আসছিলেন প্রত্যেকেই এখন অন্য কিছু করার কথা ভাবছেন। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ পুঁজির অভাবে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তারাই পড়েছেন সবচেয়ে বিপদে। সৈকতের ডাব বিক্রেতা, কাঁকড়া বিক্রেতা, চা বিক্রেতা, হকারসহ নিম্ন আয়ের মানুষের আজ ত্রাহি অবস্থা। কর্মহীনতার ফলে তাদের পরিবারে দেখা দিয়েছে অভাব। সেই অভাবের কারণে অশান্তি। অনেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। কবে ঋণ শোধ দিতে পারবেন নিজেও জানেন না।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুয়াকাটা পর্যটন এলাকা হওয়ার কারণে এখানে অধিকাংশ মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে পর্যটন-নির্ভর ব্যবসা বাণিজ্য জড়িয়ে আছে। করোনার কারণে পর্যটক না থাকায় তাদের জীবনের ছন্দ কেটে গেছে। সরকারি-বেসরকারি সহায়তার ব্যবস্থা যতটুকু হয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। এই দুর্দিনে পর্যটনসংশ্লিষ্ট ধনী ব্যবসায়ীদের তাদের সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসা উচিত বলে তারা মনে করেন।

 

ঢাকা/তারা