সাতসতেরো

ইতিহাসে আয়া সোফিয়ার রূপবদল

তুরস্কের বিশ্বখ্যাত আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরদোয়ান প্রশাসন। গত ১০ জুলাই আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এরদোয়ান আয়া সোফিয়ার দায়িত্ব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যাস্ত করেন। এমন সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেকে। তৈরি হয়েছে গুঞ্জন। 

ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ধর্মীয় এবং স্থাপত্যকলা- উভয় দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মীয় কারণে এবং সাম্রাজ্যের ভাঙাগড়ায় এটি নানা সময়ে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। কখনো অর্থডক্স, কখনো ক্যাথলিক চার্চ, আবার কখনো এটি মসজিদে রূপান্তরিত হয়েছে। মূলত ক্ষমতার পালাবদলে এবং শাসকদের মর্জিমতো এই পরিবর্তন হয়েছে।

তুর্কি ভাষায় এই স্থাপনার উচ্চারণ ‘আয়া সোফিয়া’। তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি নির্মিত হয় বাইজেন্টাইন শাসক প্রথম জাস্টিনিয়ানের সময়; তারই নির্দেশক্রমে। তৎকালীন কনস্টান্টিনোপল শহরের এই স্থাপনা সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। আয়া সোফিয়া নির্মিত হওয়ার আগে এই স্থানে প্রথম খ্রিষ্টান রোমান সম্রাট প্রথম কনস্টানটাইনের নির্দেশে ক্যাথেড্রাল নির্মিত হয়। তারও আগে সেখানে প্যাগান ধর্মের অনুসারীদের উপাসনালয় ছিলো।

আয়া সোফিয়ার ভেতরের কারুকাজ

আয়া সোফিয়ার নির্মাণ কাজ ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে শেষ হয় ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। স্থপতিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অ্যানথেমিয়াস অব ট্রেলস এবং ইসিডোরাস অব মিলেটাস। অনুদৈর্ঘ্য প্রাসাদোপম স্থাপনাটির মাঝামাঝি মূল ভবন। ৩২ মিটার প্রধান গম্বুজের সঙ্গে দুটি পার্শ্বগম্বুজ স্থাপনাটির মূল কাঠামো।

আয়া সোফিয়ার প্রধান চার্চ নির্মিত হয় ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম কনস্টানটাইনের নির্দেশক্রমে একটি প্যাগান উপাসনালয়ের ভিত্তির উপর। দ্বিতীয় কনস্টানটিয়াস ৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে এটি পুনরায় নির্মাণ করেন। ৪০৪ খ্রিষ্টাব্দে দাঙ্গায় এর পতন হয়। এখানেই শেষ নয়, ইতিহাস বলছে, ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে নিকা বিদ্রোহে এটি ভস্মিভূত হয়। এরপরই মূলত প্রথম জাস্টিনিয়ান আয়া সোফিয়াকে জমকালো প্রাসাদে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন।

আয়া সোফিয়া নির্মাণের পর থেকে ১২০৪ সাল পর্যন্ত এটি গ্রিক অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের উপাসনালয় ছিলো। এরপর ১২৬১ সাল পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ক্যাথেড্রাল হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে যে গঠন কাঠামোর উপর স্থাপনাটি দাঁড়িয়ে আছে তা মূলত ষষ্ঠ শতকের স্থাপনা। ৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে এর প্রধান গম্বুজ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া আরো দু’বার এটি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাইরের দিকটি বেশ কয়েকবার জাঁকজমক করে তৈরি করা হয়েছে। ১৪৫৩ সালে অটোমান সম্রাট দ্বিতীয় মেহমেদ কনস্টান্টিনোপল জয় করেন। তিনি সেখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাইজেন্টাইন স্থাপনাকে মুসলমানদের ধর্মীয় উপাসনালয় মাসজিদে রূপান্তরিত করেন। এসময় তিনি আয়া সোফিয়ার বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। ভেতরের অংশে থাকা অর্থডক্স প্রতীকসমূহ সরিয়ে ফেলা হয় কিংবা প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। তিনি একটি কাঠের মিনার স্থাপন করেন, একটি বিশাল ঝাড়বাতি স্থাপন এবং ইমামের জন্য একটি মেহরাব ও মিম্বার সংযুক্ত করেন। মূল স্থাপনার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে থাকা লাল মিনারটিও এ সময় সরিয়ে ফেলা হয়।

আয়া সোফিয়ায় দর্শনার্থীর ভিড়

প্রায় পাঁচ শতাব্দী মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্ক সেক্যুলার তুরস্ক গঠন করার অংশ হিসেবে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিতে ধর্মীয় উপাসনা নিষিদ্ধ করেন এবং ১৯৩৪ সালে এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৮৫ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত হয়।

এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর থেকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের ঘোষণা দিলেও স্থাপনাটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। নামাজের সময় ছাড়া যেকোনো ধর্ম-বর্ণের মানুষ কোনো প্রবেশমূল্য ছাড়াই ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন। নামাজের সময় শুধু দেয়ালের চিত্রকর্ম সম্বলিত মোজাইকগুলো লাইট অথবা পর্দার মাধ্যমে ঢেকে দেওয়া হবে। নামাজ শেষে পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য সেগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

এরদোয়ানের এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই জনপ্রিয়তা ধরে রাখার রাজনৈতিক চাল হিসেবে মনে করছেন। অনেকেই মনে করেন, এই সিদ্ধান্তের জন্য এরদোয়ানের আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন ছিলো না, আদালতের রায়ের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে শুধু বৈধতা আনা হয়েছে। তবে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় পাশ্চাত্য স্থাপত্যকলার এই প্রাচীন নিদর্শনটি এখন আর ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তুরস্কের নাগরিকেরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তথ্যসূত্র: ব্রিটানিকা, ওয়ালস্ট্রিট, সিএনএন, ইন্ডিয়ানএক্সপ্রেস

 

ঢাকা/তারা