সাতসতেরো

মা জাহেদার জন্য সাহায্যের আবেদন

ঠিক ৬/৭ মাস আগে আগুনে পুড়ে যাওয়া মুখ নিয়ে মা জাহেদা বেগম এসেছিলেন আমার অফিসে সাহায্যের জন্য। ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত-অসহায় তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি অসুস্থ। … ‘বাবারে আমাকে একগ্লাস পানি খাওয়াও তো' …তার সঙ্গে এ আমার প্রথম কথা। ডেকে বসালাম, পানি দিলাম। প্রশ্ন করলাম- আপনার এমন অবস্থা কেন?।

তিনি উত্তর দিলেন, ‘বাবারে- গতবছর পেঁয়াজ ওঠার সময় ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখি গরুর ঘরে আগুন। একটা গরু ছিল সেই ঘরে। আমার একমাত্র সম্বল। গরু বাঁচাতে আগুনের মধ্যে কখন যে চলে গেছি, টের পাইনি। কিছুক্ষণ পর যখন টের পেলাম তখন আমার আদরের গরুটি মারা গেছে। আমার মুখসহ পুরো শরীর পুড়ে গেছেরে বাবা’।... বলেই হাওমাও করে কেঁদে উঠলেন। 

পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতেই জাহেদা বেগম জানালেন, তার দুইটা মেয়ে। বড়টার বিয়ের কিছুদিন পর জাহেদা বেগমের স্বামী তাকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করেন, ছোট মেয়ে কল্পনা এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। ‘গরুটার বাচ্চা হলে দুধ বেচে কল্পনাকে পড়ালেখা করানোর ইচ্ছা ছিল। সেটাও পুড়ে মারা গেল। একটা মানুষের কয়বার কপাল পুড়ে বাবা?... বলতে পারো? কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন মা জাহেদা। আরও বলেন, আগে ২/৩বাড়ি কাজ করে কোনরকম কষ্ট-সৃষ্টে সংসার চালাতাম। করোনার কারণে সেটাও নাই, তাই বাধ্য হয়ে মানুষের দরবারে হাত পাতি। কোনদিন ভাবিনি আমাকে ভিক্ষা করতে হবে। ভিক্ষা করে যেটা পাই তাতে সংসার চলে না। আমার এমন চেহারা দেখলে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। দুপুরে কল্পনা না খেয়ে আছেরে বাবা। এ দেখ ৪৫ টাকা পেয়েছি। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কখন বাড়ি যাবো, কখন রান্না করবো কখন খাবে? …বলেই হাওমাও করে কেঁদে দিলেন। আমি কষ্ট পেলাম, কারণ তার কথাগুলো শুনতে গিয়ে কোনো এক অজানা ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলাম। 

মানিব্যাগে থাকা ২০০ টাকা তাকে দিলাম, তিনি আরও বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। চলে যাওয়ার সময় আমার ফোন নম্বর দিয়ে বল্লাম, যখন খুববেশী খারাপ লাগবে- আমাকে ফোন দেবেন, আমি যতটুকু পারি চেষ্টা করবো। সেই থেকে প্রতিমাসে যতটুকু পারি সাহায্য করি। যেটা খুব সামান্য।

একদিন দুপুরে আমার এক সহযোগীকে নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। প্রথমে (রাঙ্গামাটি, পুঠিয়া রাজশাহী) বাজারে গেলাম মুখপোড়া ওই নারীর সম্পর্কে বাজারে খোঁজখবর নিলাম। সবাই তার অসহায়ত্ব-সংগ্রামের কথা বললেন, কোথায় বাড়ি দেখিয়ে দিলেন। বিকেল আড়াইটার দিকে হাজির হলাম তার বাড়িতে। …মা জাহেদা এবং তার 'স্বপ্ন' কল্পনা কেউ বাড়ি নাই, ‘খড়ি কাটতে গেছে' -কল্পনার নানি ওজু করতে করতে বললেন। আমি পরিচয় দেওয়ায় আমাকেও চিনলেন। প্রায় ৩০ মিনিট পর মা ‘জাহেদা এলেন কাঁদামাখা শরীরে। বললাম, কি রান্না করেছেন? ‘এখনও রাঁধিনি বাবা, রাঁধবো।'

দীর্ঘ ২ মাস পর আজ সকালে ফোন দিলেন। তার কান্নাভরা কথাগুলো মনে পড়তে লাগলো। কষ্ট হয়… মা জাহেদার জন্য…। কষ্ট হয়, কল্পনার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য...।