সাতসতেরো

নিষেধাজ্ঞায় থেমে যায় সব কোলাহল

আজ ১৪ অক্টোবর থেকে ইলিশের প্রজননকালীন নিষেধাজ্ঞা শুরু হলো। ২২ দিনের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।  দিনটি সামনে রেখে আড়তদার-মৎস্যজীবীসহ সব শ্রেণীর মানুষের প্রস্তুতি থাকে। তারা ১৩ অক্টোবর থেকেই কাজকর্ম গুটিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। 

বলছি সমুদ্রের মোহনায় জেগে থাকা ঢালচরের কথা। প্রায় ষাট বছর আগে আবিষ্কৃত এই দ্বীপ প্রথম দিন থেকেই মৎস্য আহরণের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। এখান থেকেই জেলেরা বিভিন্ন হাটে মাছ বিক্রি করতে নিয়ে যেত। পরে এখানেই গড়ে ওঠে মৎস্যকেন্দ্র। এখন আর মাছ বিক্রির জন্য জেলেদের অন্য কোথাও যেতে হয় না, বরং মৎস্য ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। বিনিয়োগ হয় কোটি কোটি টাকা। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিপুল পরিমাণ ইলিশ যায়; সরকারের রাজস্ব আয় হয় মোটা অঙ্কের। আর এভাবেই ঢালচর ইলিশকেন্দ্রিক গুরুত্বপূর্ণ এক জনপদে পরিণত হয়।

জালে ইলিশ ধরা পড়লে সবার মুখেই ফুটে ওঠে হাসি

ঢালচর দ্বীপের অবস্থান ভোলার চরফ্যাসন উপজেলায়। চারদিকে থইথই জলরাশির মধ্যে জেগে আছে এই দ্বীপ। বছরান্তে ইলিশ ধরার মৌসুম এলে হেসে ওঠে দ্বীপের মানুষ। সাড়া পড়ে যায় চারদিকে। মৌসুমের জন্য জেলেরা নতুন জাল কেনেন, ট্রলার মেরামত করেন, ট্রলারে লাগিয়ে নেন সৌর বাতি। আড়তদার আগের বছরের হিসাবের খাতা বস্তাবন্দি করে লাল কাপড়ে মোড়ানো নতুন খাতায় হিসাব খোলেন। ইলিশ মৌসুম ঘিরে এ এক অন্যরকম প্রস্তুতি। এই সময়ের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ভর করে কেউ বাড়ির ঘরদোর ঠিক করার প্রস্তুতি নেন; বউ-ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামাকাপড় কেনা, ছেলেমেয়ের বিয়ে কিংবা দীর্ঘমেয়াদে অসুখে ভোগা কাউকে ডাক্তার দেখানোর চিন্তাটাও ইলিশের মৌসুমকে কেন্দ্র করেই এই অঞ্চলের মানুষ ভেবে রাখেন। এটা শুধু ঢালচরের জন্য নয়, সব ইলিশ ঘাটের চিত্র এমনই। 

ঢালচরের জমজমাট অবস্থা এবং ম্রিয়মান এই সময়ের মধ্যে তফাত অনেক। ভরা মৌসুমে ঢালচরে অবস্থান করে দেখেছি, ইলিশের ঝুড়িটা পর্যন্ত যেন ইলিশের অপেক্ষায় থাকে। বরফ বোঝাই কার্গো এসে অপেক্ষায় থাকে কখন ইলিশ আসবে। ঘাটে শত শত ইলিশ ট্রলারেরও একই অপেক্ষা। আবার এখানে কিছু মানুষ অপেক্ষা করেন বড় মাছের বাজারে ইলিশ পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এত কষ্টের পরে মৌসুমের শেষ দিকে এসে যেন সবার চেহারায় অন্য এক দ্যুতি ধরা পড়ে। কেননা প্রস্তুতি শুরু হয় তখন বাড়ি ফেরার। মৌসুমের শেষের দিকে বাড়িতে বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ধুম পড়ে। মাঝি জেলেদের দাওয়াত দিয়ে না খাওয়ালে, নতুন কাপড় না দিলে অপূর্ণতা থেকে যায়। যদিও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাবের কারণে এসব রেওয়াজ এখন আর আগের মতো পালন হয় না। এক সময় মৌসুমের শেষে মাঝির বাড়িতে খাসি জবাই করে খাওয়ানো হতো।

ঘাটে ট্রলার ভিড়েছে, নামানো হচ্ছে ইলিশ

ইলিশের ভরা মৌসুমে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করে ঢালচরের মানুষের নানান ব্যস্ততা দেখেছি। জান্টু মিয়া অথবা নুরুল ইসলামের হোটেলে এই সময় বসার জায়গা পাওয়া যায় না। রাতদিন সবার সমান ব্যস্ততা। ইলিশের মৌসুমকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে ওঠে নানান ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। বাজারের মাঝখানের খোলা স্থানটুকু মানুষের ভিড়ে জেগে থাকে প্রায় সারা রাত। প্রতিদিন বিকেলে হওলাদার বাজারের ঘাটে ভেড়ানো ছোট লঞ্চটিতে আসে অনেক ধরনের মালামাল। মুদি দোকানের সদাইপাতি থেকে শুরু করে ইলিশ ধরার ট্রলারের তেল-ডিজেল পর্যন্ত। ইলিশ সংরক্ষণের জন্য বরফের ব্যবসাও এখানে জমজমাট হয়ে ওঠে। যদিও নদী ভাঙনের কারণে এই বাজার অনেকখানি সরে এসেছে। তবুও মানুষ এখানে আছে গাদাগাদি করে। কিন্তু অনেকেই শঙ্কিত সামনের বছর এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন কিনা। অনেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন- ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র চলে যাবেন। আমিও যখনই ঢালচরে যাই, দেখি নতুন আরেক ঢালচর। দিনদিন অবস্থা বদলায়। এবছর ঘূর্ণিঝড় আম্পান যেমন ঢালচরের ক্ষতির বড় কারণ হয়েছে, তেমনি অতিরিক্ত জোয়ারের চাপও ঢালচরের ক্ষতি করেছে। তারপরও মানুষ এখানে থাকে ভালো দিনের আশায়। 

ভরা মৌসুমে ভোরের ঢালচর একেবারে অন্যরকম। সূর্য ওঠার আগে থেকেই অপেক্ষার শুরু- কখন ভিরবে ইলিশের ট্রলার। রাতে যেসব ট্রলার সমুদ্র কিংবা নদীতে ইলিশ ধরে, তারা ভোরে ঘাটে ফিরে আসে। কোনো ট্রলার ইলিশ নিয়ে আসতে পারে, কোনোটা ফাঁকা। প্রতিটি ইলিশ আড়তের সামনে যথারীতি বাক্স থাকে। কারও বাক্স পূর্ণ হয়, কারও বাক্স অর্ধেক ভরে, কারও বাক্স পড়ে থাকে ইলিশশূন্য। ঢালচরে ইলিশের আড়ত আছে প্রায় ৬০টি। এবার প্রতিদিন  গড়ে ১০-১২টির বেশি আড়তে ইলিশ উঠতে দেখিনি। জেলে, আড়তদারসহ সবার চেহারায় হতাশা। আড়তদারেরা বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে। তাদের কাছ থেকে দাদন নেয় মাঝি। এই দাদনের টাকা থেকেই জেলে রাখতে হয়। ফলে সবার নজর থাকে ইলিশ পাওয়া, না-পাওয়ার দিকে।

নিষেধাজ্ঞায় সব কোলাহাল এভাবেই থেমে যায়

ঢালচরে আপনার চোখে কয়েক ধরনের ট্রলার-নৌকা চোখে পড়বে। এগুলো তিনভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে প্রথম ভাগে ফেলা যায় বড় ট্রলারগুলো। এগুলো গভীর সমুদ্রে ইলিশ ধরতে যায়। এতে লোক থাকে ১৬ থেকে ২২ জন। এ ধরনের নতুন ট্রলার জলে ভাসাতে ৪০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা খরচ হয়। সঙ্গে আরও যোগ হয় ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকার জাল। ইঞ্জিন এবং অন্যান্য খরচ আছে আরও ১০ লাখ। গভীর সমুদ্রগামী এই ট্রলারগুলো আবার দু’ভাবে বিভক্ত। একটি ‘লাল জাল’ এবং অপরটি ‘সাদা জাল’ হিসেবে পরিচিত। লাল এবং সাদা রঙের সুতার তৈরি জাল ব্যবহার করে বলে এদের এই নাম। লাল জালের ট্রলার একটু বেশি প্রভাবশালী।

মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা ট্রলাগুলো ‘ডুবা ট্রলার’ হিসেবে পরিচিত। এগুলো সমুদ্র মোহনা এবং নদীতে ইলিশ ধরে। ভূমি থেকে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে যায় এই ট্রলার। এই ট্রলারে লোক থাকে ৬ থেকে ৮জন। এই ধরনের ট্রলার জলে ভাসাতে সব নিয়ে খরচ পড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। প্রতি মৌসুমে এই ট্রলার চালাতে অন্তত ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পূঁজি নিয়ে নামতে হয়। অন্যদিকে ছোট ইলিশ নৌকাগুলো সাধারণত নদীতে জাল ফেলে। কারেন্ট জাল ব্যবহার করে বলে এই নৌকাগুলো ‘নেটওয়ার্ক’ বলে পরিচিত। এই ইলিশ নৌকা জলে ভাসাতে খরচ পড়ে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা। ৪ থেকে ৫জন লোক হলেই এই নৌকা চালানো যায়।

গুটিয়ে রাখা হচ্ছে ইলিশ ধরার জাল

ঢালচর ঘুরে, আরও অনেক ইলিশঘাটের খোঁজ নিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট যে, এবার ইলিশ পড়েছে কম। সরকারের খাতায় ইলিশ ভরা দেখালেও বহু জেলে এবং আড়তদারের খাতা এবার শূন্য। এর কারণ কী? অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রথমত, এ বছর সমুদ্র থেকে ইলিশ খুব একটা নদীতে আসেনি। যেসব ট্রলার বড় বিনিয়োগ করে সমুদ্রে গিয়েছে তারা কিছু ইলিশ পেয়েছে। কিন্তু সমুদ্র মোহনা এবং নদীতে মাছ ধরেছে যারা তারা ইলিশ পেয়েছে খুব কম। সমুদ্র মোহনা আর নদীতেই জেলের সংখ্যা বেশি। দ্বিতীয়ত, আগের তুলনায় জেলের সংখ্যাও বেড়েছে।

ফলে সরকারের খাতায় ইলিশ লক্ষ্য অর্জনের ইঙ্গিত দিলেও জেলের মুখে এবার হাসি ফোটেনি। তাইতো নিষেধাজ্ঞা আসে, আপাতত ফুরায় সমস্ত আয়োজন, কোলাহল থামে, মলিন মুখে বাড়ি ফিরে যায় বহু জেলে। আবার শুরু হয় তাদের সংকটের দিন। এই সংকট টিকে থাকার, সংসারে পরিবার নিয়ে দু’মুঠো খেয়ে-পরে বাঁচার।