সাতসতেরো

হ‌ুমায়ূনের সৃষ্টিতে জন্ম

বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা না থাকলে বোধকরি বিস্ময়কর সৃষ্টিও করা যায় না। সাধারণের ভেতরে অসাধারণত্ব খুঁজে ফেরা এবং সেই অভিজ্ঞতা আবার সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, এভাবেই সৃষ্টির  চক্রে জড়িয়ে পড়েন লেখক। হ‌ুমায়ূন আহমেদের আগ্রহের বিশাল অংশজুড়েই এই সাধারণ মানুষ। সাধারণের যাপিত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয় পরম মমতায় তুলে এনেছেন তার সৃষ্টিকর্মে। স্বাভাবিকভাবেই জন্মের মতো এত মহত্তম ঘটনাকে হ‌ুমায়ূন আহমেদ যে শুধু মস্কিষ্ক দিয়ে নয়, গভীর আবেগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন তা বলাবাহুল্য। তার গল্প, উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্রে জন্ম বিষয়টি এসেছে বারবার। ঘটনা, পরিপ্রেক্ষিত, চরিত্র আলাদা আলাদা হলেও, একটা জায়গা কিন্তু পরিষ্কার। হ‌ুমায়ূন আহমেদ জন্মকে অনুভব করেছেন বিস্ময়মাখা অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে, আপ্লুত হয়েছেন আবেগে।

পিএইচডির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালীন ঘটনাগুলো নিয়ে হ‌ুমায়ূন আহমেদ লেখেন ‘হোটেল হ্রেভার ইন’। বইটিতে তার মেজ মেয়ে শিলার জন্মের সময়ের বিস্তৃত বর্ণনা দেন লেখক। তার ভাষায়, গুলতেকিনকে বিশেষ ধরনের টেবিলে শুইযে রাখা হয়েছে। তার দু পাশে দুজন নার্স। ড. মেলয় ছুরি কাঁচি গুছিয়ে রাখছেন। ...ডেলিভারি পেইনের কথা শুধু শুনেছি। এই ব্যথা যে কত তীব্র, কত ভয়াবহ সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেল। থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। কাটা কোরবানীর পশুর মতো গুলতেকিন ছটফট করছে। ডাক্তারকে বললাম, দয়া করে পেইনকিলার দিন। নির্বিকার ডাক্তার বললেন, পেইনকিলার দেওয়া যাবে না। আর মাত্র কিছুক্ষণ। এই কিছুক্ষণ আমার কাছে অনন্তকাল বলে মনে হলো।  একসময় প্রতীক্ষার অবসান হলো। জন্ম হলো আমার দ্বিতীয় কন্যা শীলা। হাত-পা ছুড়ে সে কাঁদছে, সরবে এই পৃথিবীতে তার অধিকার ঘোষণা করছে। .... সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ হয়তোবা ইতোমধ্যে তাকে অভিভূত করে ফেলেছে।

শুধু আত্মজার ক্ষেত্রেই নয়, সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে-পরে মাতৃমনস্তত্ব নিয়ে যে ছবিগুলো একেঁছেন সেখানেও লেখকের  বিস্ময় আর আবেগের উপস্থিতি প্রবল। তার বড় গল্প ‘জ্বীন  খলিফা’র কথাই ধরা যাক না। প্রথমবারের মতো মা হতে যাচ্ছেন লতিফা। এত বড় সংবাদ স্বামীকে কীভাবে দেবেন? আশ্রয় নিলেন ধাঁধার। স্বামীকে বললেন, এই ধাঁধাটা পারেন কিনা বলেন? ‘কাটলে বাঁচে, না কাটলে মরে এমন ফল কোন গাছেতে ধরে।’ স্বামী পারলেন না। ধাঁধাটি কয়েকবার বললেন লতিফা। প্রতিবারই স্বামীর উত্তর না। অগত্যা লতিফাই খোলাসা করে দিলেন। সন্তানকে বাঁচাতে হলে নাড়ী কাটতে হয়, বুঝিয়ে  দিলেন। এই ধঁধাটি অবশ্য আরও বেশ কয়েকটা জায়গায় ব্যবহার করেছেন  হ‌ুমায়ূন আহমেদ। ‘অয়োময়’ নাটকে তার স্বামী কাশেমকে তার ছোট বউ ছাবিহা সন্তান ধারণ করার কথা একইভাবে জানান। এই নাটকেই জমিদারের দ্বিতীয় স্ত্রী এলাচি বেগম কন্যা সন্তানের জননী হন। সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে রাজবাড়ির সবাই ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ রাতে দাইকে আনা হয়। সদরে নেওয়ার জন্য দ্রুতগামী নৌকা প্রস্তুত রাখেন নতুন জমিদার কাশেম। জগৎ সংসার সম্পর্কে উদাসীন আগের জমিদার মির্জা বারবার বলেন- কিচ্ছু হতে পারে না। সবকিছুর বিনিময়ে আমি সন্তানকে পাচ্ছি। জাগতিক কোনো কিছুর প্রতি আসক্তি না থাকলেও অনাগত সন্তানের প্রতি পুরনো জমিদার মির্জার যে ভালোবাসা তা বলে দেয় অনেক কিছুই। সন্তান জন্ম হওয়ার চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না, এই সত্যটিই তুলে ধরেছেন লেখক। কোনো অঘটন ঘটেনি। শিশু আসে মাযের কোলজুড়ে। উৎসব, উচ্ছ্বাসের মধ্য দিযে কন্যা শিশুটির নাম রাখা হয়। গীত পরিবেশন করা হয়: ‘উত্তরে দেখিলাম জয়নাব নামে কন্যার নামও রাখিলাম দক্ষিণে দেখিলাম জয়নাব নামে কন্যার নামও রাখিলাম আসমানে দেখিলাম জয়নাব নামে কন্যার নামও রাখিলাম মাটিতে দেখিলাম জয়নাব নামে কন্যার নামও রাখিলাম।’ লেখক মননে শিশুর জন্ম, অতঃপর নাম রাখা- এর চেয়ে বড় উৎসব আর কি  হতে পারে? ‘এইসব দিন রাত্রি’ ধারাবাহিক নাটকে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় জটিলতা দেখা দেয় বাড়ির ছোট মেয়ে শাহানার। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যান শাহানা। হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। জরুরিভিত্তিতে রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্ত চেয়ে মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। চেনা, অর্ধ চেনা সবাইকে ফোন করতে থাকেন শাহানার স্বজনরা। হঠাৎ করেই রক্ত পাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। এই পর্যায়ে হতাশ, বিধ্বস্ত শাহানার স্বামী বলেন, আমার কোনো কিছুই ঠিক হয় না, কোনো কিছুই ভালো হয় না।’ অনেক চেষ্টার পর রক্ত পাওয়া যায়। মা, সন্তান দুজনই সুস্থ হয়ে ওঠে। বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। উৎসবমুখর হয়ে ওঠে বাড়ি। শাহানার স্বামী বলেন, পৃথিবীটাকে যতটা খারাপ ভাবা হয় জায়গাটা কিন্তু ততটা খারাপ নয়।’ একটি জন্ম ব্যক্তি দর্শনের উপর যে কতটা প্রভাব ফেলে শাহানার স্বামীর মুখ দিয়ে সেই বার্তাটিই যেন দিয়েছেন লেখক।

সন্তানকে দুনিয়াতে আনা এবং তাকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ করে মা যে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে পারেন তেমনই একটি উপন্যাস ‘কহেন কবি কালিদাস।’ বইটিতে স্কুলে পড়াকালীন প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সায়রা বানু। সন্তানও আসে। নিজের সন্তানকে রক্ষার জন্য একের পর এক হত্যা করেন সায়রা। মা, বোনকে  হত্যা করার পর নিজের স্বামীকেও আর্সেনিক খাইয়ে ধীরে ধীরে অসুস্থ করে তোলেন। আর তার বাবাকে ইবলিশ শয়তানের গল্প ফেঁদে আড়ালে রাখেন মূল ঘটনা। মোট কথা, সন্তানের বিষয়টি জেনে যেতে পারে এমন আশঙ্কা দেখলেই তাকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেন সায়রা বানু। বিদেশে পিএইচডি করার সময় নিজের মেয়েকে কাজের মেয়ে হিসেবে রেখে দেন তাদেরই বাড়িতে। নাসরিন নামের এই মেয়েটিকে কাজের সাহায্যের জন্য মিসির আলীর কাছে পাঠান ড. সায়রা। এই রহস্যভেদ করেন মিসির আলী। কাজের মেয়ে পরিচয়ে বেড়ে ওঠা নাসরিন আসলে ডক্টর সায়রা বানুরই আত্মজা।

আসলে প্রকৃতি তার উত্তরাধিকার রক্ষা করতে চায়, তুমিও তাই করেছ। ডক্টর সায়রাকে এমন কথা বলেন মিসির আলী। এতগুলো হত্যার দায়ভার নিয়ে তার পুলিশের কাছে কাছে যাওয়া উচিদ কিনা মিসির আলীর কাছে জানতে চান সায়রা। মিসির আলী বিষয়টা ছেড়ে দেন সায়রার উপরই।

একটা শিশু মাটির দুনিয়াতে আবির্ভাবের বিষয়টা নিযে হ‌ুমায়ূন আহমেদের একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করা যাক। লেখক তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ডিগ্রি পরীক্ষার এক্সটারনাল হিসেবে মাঝেমধ্যেই মফস্বলে যেতে হতো লেখককে। একবার ভিন্ন একটা অভিজ্ঞতা হলো হুমায়ুন আহমেদের। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন একটি মেয়ে। সন্তানসম্ভবা মেয়েটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তখনও মেয়েটির ভাইভা বাকি। এদিকে প্র্রাকটিক্যালে ফেল করা মানে পুরো পরীক্ষাতেই ফেল। মাঝামাঝি  কোনো পথ নাই। এ অবস্থায় মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে ভাইভা নেওয়ার প্রস্তাব করলেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। কলেজের শিক্ষকদের রাজী করিয়ে কয়েকজনকে নিয়ে  হ‌ুমায়ূন আহমেদ গেলেন ওই পরীক্ষার্থীর বাড়ি। ওই বাড়িতে তখন আনন্দের ঢেউ। মেয়েটি সন্তানের মা হয়েছে। হ‌ুমায়ূন আহমেদকে দেখে বাড়িতে ভিড় জমে গেল। শিশুটির বাবা আবারো মিষ্টি আনতে ছুটলেন বাজারে। মেয়েটি ও তার স্বামী তো বটেই, বাড়ির আশপাশের মানুষদের বিস্মিত চোখমুখ দেখে অভিভূত হলেন লেখক।

জন্ম এভাবেই অভিভূত করেছে হ‌ুমায়ূন আহমেদকে, আর আমরা পেয়েছি অসাধারণ সব লেখা।