সাতসতেরো

বাড়ির ছাদে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট

একান্নবর্তী পরিবার ভাঙছে। তৈরি হচ্ছে একক পরিবার। কালের অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে একান্নবর্তী সংসারের মধুর অতীত। সেই সুখস্মৃতি ধরে রাখতে চাইছেন লুতফি চৌধুরী। তিনি এ জন্য নিয়েছেন অভিনব উদ্যোগ। রাজধানীর মিরপুরের ‘কালাম সাহেবের বাড়ির’ পারিবারিক বন্ধন তৈরি করেছে নতুন উদাহরণ।

জীর্ণ কংক্রিটের এই নগরীর সব কিছুই যান্ত্রিক মনে হয়! সেই যান্ত্রিকতার যন্ত্রণা দূর করতে পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে ১১ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এফসিএল- ফ্যামিলি ক্রিকেট লীগ। নামেই পরিচয়; এই লীগে পরিবারের সদস্যরাই অংশগ্রহণ করেন। চমকের এখানেই শেষ নয়। যারা বলেন এই নগরীতে মাঠ নেই, তাই খেলাধুলাও নেই। তারা নতুন করে ভাবতে পারেন লুতফি চৌধুরীর এই উদ্যোগে। তিনি বাড়ির ছাদেই আয়োজন করেন এই ক্রিকেট লীগের।

সম্প্রতি শেষ হয়েছে এফসিএল-এর ১১তম আসর। খেলাধুলার মাধ্যমে পরিবারের সবাইকে একত্রিত করার এই মহৎ প্রচেষ্টা প্রসঙ্গে লুতফি চৌধুরী বলেন, ‘মাঠের অভাবেই আমাদের ছাদে খেলা শুরু। প্রায়ই আমরা ছাদে খেলতাম। হঠাৎ মনে হলো, আত্মীয়-স্বজন সবাই ব্যস্ত, কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা হয় না বললেই চলে। খেলাটাকে যদি পিকনিকের মতো কোনো অনুষ্ঠানে রূপ দেওয়া যায়, তাহলে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে গেট টুগেদার করা সম্ভব। মুরুব্বিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হলে তারাও সানন্দে রাজি হন। তাদের সহযোগিতায় এফসিএল শুরু হয় ২০১০ সালে।’

পরিবারের সদস্যরা মাঠে উপস্থিত। সবার মনে আনন্দ

পারিবারিক টুর্নামেন্ট হলেও এই আয়োজন পুরোটাই পরিচালিত হয় আইপিএল-এর আদলে। অর্থাৎ খেলোয়াড় নির্বাচন, দল গড়া, খেলার ফরম্যাট প্রায় সবই করা হয় নিয়ম মেনে। খেলা হয় চারটি দলে বিভক্ত হয়ে। দলগুলো হলো ফ্যান্সি গ্ল্যাডিয়েটরস, সানরং বার্নার্স, সুবেসি রাইডার্স এবং উইসকাল টাইগার্স। প্রতি দলে থাকে ৭ জন খেলোয়াড়। বয়সের খুব বেশি বালাই নেই, ১১-৪০ সবাই খেলোয়াড়। তবে আত্মীয়র বাইরে কাউকে নির্বাচন করা হয় না। মজার ব্যাপার দলগুলোর মালিক হচ্ছেন পরিবারের মুরুব্বিরা। তারা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেন কে কোন দলে খেলবেন। লুতফি চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী ‘দল নির্বাচনের দিন আরেকটি উৎসবে পরিণত হয়। দল নির্বাচন হয় খেলার এক সপ্তাহ আগে। চলে খেলোয়াড় কেনা-বেচা। চারটি দলের মালিকরা আইপিএল-এর নিলামের মতো খেলোয়াড় কিনে নেন। যদিও এই টাকা খেলোয়াড়রা পান না। এই টাকা দিয়েই টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। টাকার অঙ্ক হাজারের ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকে।’

দল নির্বাচন তো হলো, এবার কথা হয় খেলার নিয়ম প্রসঙ্গে। জানা যায়, চারটি দল লীগ রাউন্ডে প্রত্যেক দলের সঙ্গে খেলে। সেখান থেকে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ দুই দল খেলে ফাইনাল। ফ্লাড লাইটের আলোয় পরিবারের সব আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে চার-ছক্কার এই খেলা অন্য এক আবহ তৈরি করে। মাঠে থাকে টানটান উত্তেজনা। এই উত্তেজনার শুরু হয় মাসখানেক আগে থেকেই। প্রায় ২০০ আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতি সামলানো চাট্টিখানি কথা তো নয়! দাওয়াত কার্ড ছাপানো, জার্সি বানানো, বাবুর্চি ঠিক  করা, ডেকোরেটর ঠিক করা, ছাদ পরিষ্কার, ছাদ সাজানো, বাজার সদাই কেনা, খেলার সরঞ্জাম সংগ্রহ করা- সাজ সাজ রব পড়ে যায় কালাম সাহেবের বাড়িতে। লুতফি চৌধুরী বলেন, ‘খেলায় অংশগ্রহণের জন্য দেশের বাইরে থেকেও পরিবারের অনেক সদস্য দেশে আসেন।’

টুর্নামেন্ট শেষে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ, সেরা বোলার, সেরা ব্যাটসম্যান এবং প্লেয়ার অব দ্য  টুর্নামেন্ট পুরস্কার দেওয়া  হয়। পাশাপাশি অংশগ্রহণকারী সবাই পান বিশেষ ট্রফি। অর্থাৎ জয়-পরাজয় বড় কথা নয়, এখানে খেলায় অংশগ্রহণই বড় হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, সব পরিবারকে দেওয়া হয় সৌজন্য উপহার।

টুর্নামেন্টের একটি দল

সম্প্রতি পরিবারের মুরুব্বি হাজী সুলতান শেখ মারা গেছেন। এফসিএল মাঠের নামকরণ করা হয়েছে তারই নামে- শেখ সুলতান গ্রাউন্ড। লেখার শুরুতে একান্নবর্তী পরিবারের কথা বলেছিলাম। পরিবারের সবাইকে হয়তো এখন আর এক ছাদের নিচে নিয়ে আসার সুযোগ নেই। তবে এফসিএল প্রমাণ করেছে এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে সবাইকে এক ছাদের উপরে নিয়ে আসা সম্ভব।