সাতসতেরো

পৃথিবীর অমর দশ প্রেম ও বিরহগাথা

১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। একটি তরুণ এবং একটি তরুণী যখন প্রথম পরস্পরকে ভালোবাসে, তখন একদিন সেই প্রণয় পরিণয়ে রূপ লাভ করবে আর বসন্তের সবুজ কিশলয় একটা সময় সংসারনামী বৃক্ষের ফুলে-ফলে আরো পল্লবিত হবে- এমনটাই থাকে সবার প্রত্যাশা।

তবে অদ্ভুত হলেও সত্য যে, পৃথিবীর ইতিহাসে যে প্রেমিক যুগল শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে মানুষের মনে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছেন, যাদের নিয়েই হাজার হাজার বছর ধরে কবি রচনা করেছেন বন্দনা গীত, গেয়েছেন গাথা কাব্য তার প্রায় সবগুলোই বিরহবিধুর। বুঝি বা ঘর-সংসারের প্রাত্যহিকতায় একসময় হারিয়ে যায় প্রেমের ঐশ্বর্য। আগুনে পুড়ে সোনা হবার মতোই দুঃখ আর বিরহে বুঝি জ্বলে ওঠে প্রেমের আসল রূপ। বাংলার কবি তাই মধুরাত বিরহ মধুর হবার কথা লিখেছেন।

রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য পৃথিবীর নানা দেশ ও সভ্যতার, নানা সময়পর্বের পুরাণ-কিংবদন্তি-লোকগাথা-নাটক থেকে এমনি কিছু বাছাই করা চিরায়ত ভালোবাসার আখ্যান আজ পেশ করছি। তিন দিন আগে চৈনিক নববর্ষ পালিত হয়েছে বলে এই লেখাটির শুরুতে দুটো চৈনিক বিরহ-বিধুর রোমান্সের কথা তুলে ধরা হচ্ছে। তারপর একে একে আসবে গ্রিস, মিশর, ইতালি, আরব, পারস্য, ভারত ও বাংলার কাহিনি।

প্রজাপতি প্রেমিক যুগল (চীন)

লিয়াং শানবো এবং ঝু ইংতাই নামে দুই প্রেমিক-প্রেমিকার এই বিচ্ছেদ কাহিনি যেন রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের চৈনিক সংস্করণ। চীনের মানুষের কাছে আজও এই দুই তরুণ-তরুণী প্রজাপতি প্রেমিক বা দ্য বাটারফ্লাই লাভার্স নামে পরিচিত। বিরহ মধুর এই আখ্যানের সূচনা হয়েছিল চীনের পূর্বভাগে জিন রাজবংশের শাসনের সময় (৩১৭-৪২০)। সেই প্রাচীন যুগে মেয়েদের যেহেতু বড় হয়ে লেখাপড়া শেখার নিয়ম ছিল না, কাজেই ঝু ইংতাই নামে এক বিদ্যানুরাগী তরুণী পুরুষের বেশে হাং ঝু শহরে চললো ছেলেদের মতোই আরো বেশি পড়াশুনা করার উদ্দেশ্যে। যাত্রা পথে লিয়াং শানবো নামে এক যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় হলো এবং দু’জনেই ভালো বন্ধু হয়ে গেল। লিয়াং শানবো ছিল কুয়াইজি থেকে আগত এক বিদ্যানুরাগী যুবক। যাহোক, লিয়াং শানবো আর ছেলের ছদ্মবেশে ঝু ইংতাই একসঙ্গে ভর্তি হলো হাং ঝুর সোংশান একাডেমিতে। সেখানে তিন বছর একসঙ্গে পড়তে পড়তে ঝু ইংতাই মানে মেয়েটি প্রেমে পড়ে গেল সহপাঠী ও বন্ধু লিয়াং শানবোর সঙ্গে। কিন্তÍ লিয়াং ছিল খুব সাদা-সিধে, সরল মনের ছেলে আর সে ভাবতেও পারেনি যে ঝু একজন নারী। ভালো করে সে লক্ষ্যও করেনি।

এদিকে ঝু-র বাবা মেয়েকে পুরুষের ছদ্মবেশে ভিন্ন শহরে পড়তে পাঠাতে রাজি হলেও তিন বছর ধরে কন্যার অদর্শনে তিনি অস্থির হয়ে উঠছিলেন। ঝু-র মনেও বাবাকে দেখার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠছিল। কিন্তু চলে গেলে আর ফেরা হবে কিনা বা বাবা অন্য কোথাও আবার তার বিয়ে ঠিক করে কিনা এই ভয়ে ঝু ইংতাই নানাভাবে, আকারে-ইঙ্গিতে লিয়াংকে তার মনের কথা বলা শুরু করলো। বোকা-সোকা লিয়াং সেসব কিছুই বুঝলো না। কোনোভাবেই সাদা-সিধে লিয়াংকে কিছু বোঝাতে না পেরে ঝু ইংতাই তাকে শুধু বললো যে লিয়াং যেন তার শহরে (ঝু’র শহরে) একবার বেড়াতে যায়। সেখানে ঝু-র কোনো এক বোনের সঙ্গে লিয়াংকে সে পরিচয় করিয়ে দেবে এবং বিয়ে দেবে। এই কথা বলে ঝু নিজের শহরের দিকে পাড়ি জমালো। এদিকে লিয়াংয়ের পরিবার ছিল বেশ গরীব। কাজেই ঝু-কে কথা দেয়া সময়ে সে ঝু-র বাড়িতে পৌঁছতে পারল না। সামান্য টাকা-পয়সা জমিয়ে ঝু-র বাড়িতে পৌঁছাতে তার বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। যতদিনে পৌঁছল, তত দিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ঝু-র বাবা ততদিনে স্থানীয় এক বড় সরকারি কর্মকর্তার ছেলে মা ওয়েন চাইয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। সরল লিয়াংও বুঝতে পারল যে ঝু ছিল আসলে মেয়ে এবং বেচারা তাই মুখ ফুটে মনের কথাটা সরাসরি বলতে পারেনি। কিন্তু দু‘জনেরই তখন চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। সহপাঠী ও বন্ধু, ভালোবাসার মানুষ লিয়াংকে বিদায় দেবার সময় দু’জনই প্রতিজ্ঞা করলো যে এ জীবনে আর এক হতে না পারলেও মৃত্যুর পর তারা একইসঙ্গে সমাধিস্থ হবে। 

কালক্রমে লিয়াং কর্মজীবনে খুব ভালো করলো এবং একটি প্রদেশের গভর্ণর হলো। তবু মনের ভেতরে দয়িতা ঝু-কে সে ভুলতে পারেনা। একটা পর্যায়ে মানসিক বেদনা ও পরিতাপে সে অসুস্থ হয়ে পড়লো এবং মারা গেল। দূর থেকেও সেই কথা জানতে পেরে ঝু তার ভালোবাসার মানুষের এই আত্মদানের দাম বিফলে যেতে দেবে না বলে প্রতিজ্ঞা করলো। তাই মা ওয়েন চাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হবার পরও ঝু একদিন লিয়াংয়ের কবরে ছুটে গেল তাঁকে সম্মান জানাতে। কাঁদতে কাঁদতে আকাশের দিকে মুখ তুলে সে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করলো যেন লিয়াংয়ের কবরের দরজা দেবতারা তাকে খুলে দেয়। আর তখন এক অলৌকিক ঘটনা ঘটলো। কবরের দরজা খুলে গেল এবং ঝু কবরের ভেতর ঝাঁপ দিতেই সেই সমাধি আবার বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কবরের ভেতর মাটি চাপা দুই প্রেমিক-প্রেমিকা এক জোড়া প্রজাপতি হয়ে গেল। তাদের আর কোনোদিন বিচ্ছেদ হবে না। 

ময়ূরেরা উড়ে যায় দক্ষিণ-পূর্বে (চীন)

চীনের প্রাচীন কবি শি লিংইয়ুন (৩৮৫-৪৩৩ অব্দ) রচিত ময়ূরেরা উড়ে যায় দক্ষিণ-পূর্বে বা দ্য পিককস ফ্লাই টু দ্য সাউথ-ইস্ট হলো চীনের সাহিত্যিক ইতিহাসের প্রথম দীর্ঘ কবিতা। পূর্ব হান বংশে (২৫-২২০ অব্দ) ঘটে যাওয়া এক বিরহ বিধূর প্রেম এই কবিতার উপজীব্য।

পূর্বের হান রাজত্ব চলাকালীন সময়ে রাজা জিয়ান আনের সময়ে একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে লিউ লানঝির বিয়ে হলো এক পড়তি অবস্থার রাজ কর্মচারী পরিবারের ছেলে জিয়াও ঝংকিংয়ের সঙ্গে। যদিও এই দম্পতি একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসত, লিউকে তার শাশুড়ি দুই পরিবারের আভিজাত্যের পার্থক্যের কারণে খুবই তিরস্কার করতো এবং এক পর্যায়ে বাধ্য করলো মেয়েটিকে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে যেতে। বাবার বাড়ি ফিরে যাবার পর মেয়েটির বড় ভাই মেয়েটিকে জোর করে আর একটি লোকের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইলে দুঃখী মেয়েটি এক হ্রদের জলে ডুবে আত্মহত্যা করে। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে জিয়াও নিজেকেও উঠানে এক গাছের সঙ্গে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসিতে আত্মহত্যা করে। আর এভাবেই তার স্ত্রীর প্রতি নিজের বিশ্বস্ততার প্রমাণ রাখলো সে।

‘ময়ূরেরা উড়ে যায় দক্ষিণ-পূর্বে’ সামন্ত মূল্যবোধ শাসিত চীনে নর-নারীর প্রথম প্রেম ও নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করার আর্তি সম্বলিত সাহিত্যিক রচনা। নায়িকার বিশ্বস্ত প্রেম ও সাহস চীনের তরুণদের হৃদয়ে আজো প্রতিধ্বনিত হয়।

প্যারিস এবং হেলেন (গ্রিস)

রাজা মেনিলাসের স্ত্রী হেলেনকে দেখেই ট্রয়ের যুবরাজ ও সুদর্শন প্যারিস বুঝে নিলেন যে এই নারীকে তার পেতেই হবে। এদিকে হেলেন ছিলেন সেই নারী যাকে দেখে স্বয়ং আফ্রোদিতি ঘোষণা করেছিলেন পৃথিবীর সুন্দরীতমা নারী হিসেবে। মেনিলাসের অনুপস্থিতিতে তারই অতিথি প্যারিস ও হেলেন পালিয়ে গেলেন। আর সেই সঙ্গে জ্বলে উঠলো পরবর্তী এক যুগের ট্রোজান যুদ্ধের আগুন। গ্রিক পুরাণ আরো বলছে যে, হেলেন ছিলেন অর্ধেক মানবী ও অর্ধেক দৈবী সত্ত্বা। যেহেতু তার মা ছিলেন রানি লেডা এবং বাবা ছিলেন দেবতা জিউস। লেডাকে বশীভূত করতে জিউস নিজেকে এক রাজহংসে রূপান্তরিত করে ফেলেছিলেন। 

বাস্তবে হেলেন বলে কেউ ছিলেন কিনা সেটা নিয়ে যত বিতর্ক থাকুক, পৃথিবীর অন্যতম সেরা মহাকাব্যে তার উপস্থিতি কখনো ভোলার নয়। হাজার হোক হেলেন ছিলেন সেই ‘মুখচ্ছবি যার জন্য সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল হাজার জাহাজ (দ্য ফেস দ্যাট লঞ্চড আ থাউজ্যান্ড শিপস।’ 

ক্লিওপেট্রা এবং মার্ক  অ্যান্টনি (মিশর)

রোমক ইতিহাসবিদ দিও মিশরের রানি ক্লিওপেট্রার রূপের বিবরণ দিচ্ছেন: ‘দেখতে ও শুনতে মেধাবিনী, সবাইকে বশীভূত করার সক্ষমতা সহ (ব্রিলিয়ান্ট টু ল্যুক আপন অ্যান্ড টু লিসেন টু, উইথ দ্য পাওয়ার টু সাবজুগেট এভরিওয়ান)’। আচ্ছা- এখান থেকেই বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ ‘চুল ও চোখের সংকেতে মেধাবিনী’ পঙ্‌ক্তিটি লিখতে প্রাণিত হননি তো? প্লুতার্কের বিবরণ থেকে আরো জানা যাচ্ছে যে, যেহেতু সিজারের কাছে প্রথম একুশ বছর বয়সে নিজেকে একটি বিছানার চাদরে ভাঁজ করে, গুটিয়ে উপস্থাপিত করেছিলেন ক্লিওপেট্রা যার এক অবিশ্বাস্য ও প্রায় শ্বাসরোধী চিত্রায়ণ দেখা যায় লিজ টেলর অভিনীত হলিউডের ‘ক্লিওপেট্রা অ্যান্ড মার্ক অ্যান্টনি’তে, কাজেই খুব দীর্ঘকায়া ছিলেন না তিনি। বরং খানিকটা ছোট-খাটোই ছিলেন। আর হালে হলিউডের আফ্রিকান বংশোদ্ভূত নায়িকারা তো অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো ককেশাস সুন্দরীদের ক্লিওপেট্রা চরিত্রে রূপায়ণের বিরুদ্ধে সরবই হচ্ছেন। মিশরের মেয়ে ক্লিওপেট্রা কালো না হলেও বড় জোর বাদামি ছিলেন ত্বকে। তবে কেন রোমের সিজার থেকে মার্ক অ্যান্টনি সবাই তাঁর পদতলে লুটিয়ে পড়েছিলেন? রোম ইতিহাসবিদ প্লুতার্কের মতে, ক্লিওপেট্রার ছিলেন রিনরিনে সুন্দর, বাদ্যযন্ত্রের তারের মতো কণ্ঠস্বর আর ছিলেন বহুভাষী। বেশ কয়েকটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ছিলেন প্রখর ব্যক্তিত্বেরও অধিকারী। সেই সঙ্গে যৌনতার ব্যাপারেও সাহসিকা ও খোলামেলা ছিলেন।

যেমন, ক্লিওপেট্রা নিজে যে রোম সেনাপতি তথা নৃপতির প্রেমে কোনো হিসাব-নিকাশ ছাড়াই শেষপর্যন্ত পড়লেন সেই মার্ক অ্যান্টনির স্ত্রী অক্টেভিয়া রূপের হিসাবে বরং ক্লিওপেট্রার চেয়ে সুন্দরীতরা ছিলেন বলেই রোমকরা অবাক হয়েছিলেন ও অক্টেভিয়ার প্রতি সমব্যথীও হয়েছিলেন। কিন্ত সত্যি বলতে স্ত্রী হিসেবে যৌন শীতল, ঠান্ডা স্বভাবের মেয়ে পুরুষেরা যতই চাক, প্রেমিকা হিসেবে কামনার প্রকাশে সাহসী মেয়ে কে না পছন্দ করে? বিছানার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে সিজারের পায়ের কাছে আত্ম-নিবেদিত একুশ বছরের ক্লিওপেট্রাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সিজার। সিজারের মৃত্যুর পর, আটাশ বছর বয়সে এসে মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে পরিচয় হয় ক্লিওপেট্রার। এদিকে একের পর এক রোমক নৃপতির মাথা খাওয়ায় ক্ষুব্ধ রোমক কবি ও ইতিহাসবিদেরা ক্লিওপেট্রাকে নানা কটু কথা বলতে ছাড়েননি। কবি প্রপার্টিয়াস তাঁকে বলছেন গণিকা রাজ্ঞী, হোরেস তাঁকে বলছেন ভয়ানক দানবী আর লুকান তাঁকে বলছেন মিশরের কলঙ্ক (ফার্সেলিয়া, ১০,৫৯) আর অগাস্টান কবিরা তাঁকে বলছেন বিদেশিনী মায়াবিনী। রোমক রানী অক্টেভিয়ার মতো দীর্ঘকায়া নন, অমন শুভ্রাও নন। তবু বাদামি আর হ্রস্ব ক্লিওপেট্রা তাঁর কণ্ঠস্বর, বহু ভাষায় অনর্গল কথা বলার ক্ষমতা আর ব্যক্তিত্বের জোরে ছিলেন প্রচণ্ড আকর্ষণীয়। বিদ্যা ও ব্যক্তিত্বের প্রবল মদিরায় যে কোনো পুরুষকে পদতলে টানার ক্ষমতা থাকলেও নিজেই প্রথম হিসাবহীন প্রেমে ভেসে গেলেন রোমক সেনাপতি মার্ক অ্যান্টনির সঙ্গে। শেক্সপিয়ার জানাচ্ছেন এই সম্পর্ক ছিল খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। সর্বযুগের সেরা নাট্যকার ক্লিওপেট্রাকে দিয়ে বলাচ্ছেন: ‘নির্বোধ! তুমি কি বোঝ না যে তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারলে/ বিষপ্রয়োগে তোমাকে হত্যা করতে পারতাম আমি অন্তত একশো বার?’ 

রোমের সঙ্গে এক যুদ্ধে ক্লিওপেট্রা ও মার্ক অ্যান্টনি সর্বস্ব পণ করলেন তবে যখন দেখলেন যে নিশ্চিত পরাজয় এগিয়ে আসছে, তখন একসঙ্গে মৃত্যুর বা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেটা ৩০ অব্দের কথা। 

‘বিয়ের বরের সাজে সাজব মৃত্যুর মুহূর্তে আমি। আর তারপর ছুটে যাব যেন বাসর শয্যায় (আই উইল বি আ ব্রাইডগ্রম ইন মাই ডেথ/অ্যান্ড রান ইনটু ইট অ্যাজ টু আ লাভার্স বেড)’, বললেন মার্ক অ্যান্টনি। ক্লিওপেট্রা আলতো আদরে এক বিষধর সর্পকে তুলে নিলেন তাঁর বক্ষদেশে।

পশ্চিমের সাদা ঐতিহাসিকেরা ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে যত কটু কথা বলুক, তাঁকে সবসময়ই আফ্রিকার এক অসহায় বাদামী বা কালো মেয়ে বলে মনে হয় আমার, যার আপনজন বলতে ছিল বয়সে অনেক ছোট এক বৈমাত্রেয় ভাই টলেমি। সেসময়ের মিশরের রাজবংশে বয়সে বড় রাজপুত্র না থাকলে এবং রাজকন্যাই বয়সে বড় হলে তাকে সিংহাসনে বসতে হতো। খুব অসহায় নারী বলেই ক্ষণে ক্ষণে আক্রমণকারী এবং ঔপনিবেশিক রোমক রাজা বা সেনাপতিদের কাছে গণিকার মতো নিজেকে তাঁর বারবার তুলে দিতে হয়েছে। হয়তো দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতেও। ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে এক অ-শ্বেতকায় নারী ও নারীবাদী হিসেবে কোনোদিন কোনো নতুন দৃষ্টিভঙ্গির নাটক বা আখ্যান লেখার ইচ্ছা আছে এই অধম নিবন্ধকারের। 

দান্তে ও বিয়াত্রিচে (ইতালি)

গোটা পৃথিবীর সাহিত্যিক ইতিহাসেই আর কোনো কবি বা লেখক কোনো নারীকে দিয়ে এতটা প্রভাবিত হয়েছেন কিনা জানা যায় না- যতটা দান্তে হয়েছেন তাঁর বিয়াত্রিচেকে দিয়ে। অথচ যে বিয়াত্রিচে কিনা দান্তের ডিভাইন কমেডি-তে কবিকে নরক থেকে অমরাবতীর পথে পথ প্রদর্শন করছেন, সেই কবির সারা জীবনের আরাধ্যা এই নারীকে তিনি জীবনে মাত্র চার বার দেখেছেন। প্রথম কবি বিয়াত্রিচেকে দেখেন তাঁর বালক বয়সে- কবির বয়স তখন নয় এবং বালিকা বিয়াত্রিচের বয়স ছিল আট। বিয়াত্রিচের বাবা ফলকো পোর্শিনারির বাসায় এক নিমন্তণে বালক দান্তে গিয়েছিলেন তার বাবা-মা‘র সঙ্গে। দ্বিতীয়বার কবি তাঁকে দেখতে পান তরুণ বয়সে। ফ্লোরেন্সের রাস্তায় হাঁটছিলেন বিয়াত্রিচে। ততদিনে পূর্ণ যৌবনা বিয়াত্রিচে হয়ে উঠেছেন পান্নার মতো সবুজ চোখের এক সুন্দরী। বহুদিন পর দেখা হলেও কবিকে দেখেই চিনতে পারেন এক নিমেষে এবং মাথা ঘুরিয়ে তাঁকে সম্ভাষণ করতেই লাজুক কবি সম্ভাষণের উত্তর না দিয়ে এক ছুটে চলে আসেন নিজের বাসায়।

বিয়াত্রিচেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েন এবং ঘুম থেকে উঠে কবি জীবনের প্রথম সনেট রচনা করেন। দান্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ভিটা নোভা বা নবজীবনে যৌবনে তাদের এই প্রথম দেখার বিবরণ আছে। তবে সেসময় কিনা ইউরোপেও মানুষ বাবা-মা’র পছন্দমতে বিয়ে করতো বা অনেক সময় দয়িত-দয়িতা মুখ ফুটে একে অপরকে ভালোলাগার কথা বলতেই পারত না, কাজেই বিয়াত্রিচের বিয়ে হয়ে যায় জনৈক সিমোন দ্যু বার্দির সঙ্গে। বিয়ের তিন বছরের মাথায় এবং মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিয়াত্রিচে মারা যান (১২৯০ খ্রিষ্টাব্দ)। দান্তেরও বিয়ে হয় জেম্মা ডোনাটি নামে এক নারীর সঙ্গে (১২৮৫ খ্রিষ্টাব্দ)। সত্যি বলতে বিয়াত্রিচের আগেই বিয়ে করেন দান্তে। জেম্মার সঙ্গে তিনটি সন্তানও হয় তাঁর। কেন কবি বিয়াত্রিচেকে তরুণ বয়সে একবার দেখেই আকুল হয়ে কবিতা লিখতে থাকেন অথচ বিয়ে করেন অন্য নারীকে? তবে কি তিনি প্রতারণা করেছিলেন বিয়াত্রিচেকে? বিয়াত্রিচে কি সুখী হয়নি তাঁর নিজের বরের সঙ্গে এবং অকালমৃত্যু হলো তাঁর? নিজের এই প্রতারক চারিত্র্যের খানিকটা আভাস দান্তে নিজেই দিয়েছেন তাঁর দ্য ডিভাইন কমেডি-তে যেখানে বিয়াত্রিচে যখন কিনা অন্য কাজে ব্যপৃত, পুুরুষ দান্তে তখন প্রবৃত্তির তাড়নায় এক ক্রীতদাসী মেয়ের সঙ্গে ঘুমোচ্ছে এবং বদলে মেয়েটিকে ও তার ভাইকে মুক্তি দিচ্ছে। অথচ নরকে বিয়াত্রিচে শয়তান লুসিফারের সঙ্গে দান্তের চরিত্রের শুদ্ধতা নিয়ে বাজি ধরেছিল। তবে সে বাজিতে হেরে যায়। না জীবনে, না কাব্যে দান্তে বিয়াত্রিচেকে রক্ত-মাংসে কখনো পান না এবং প্রতারণাই করেন। তবু শুদ্ধাচারী বিয়াত্রিচে দান্তেকে ‘দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমা’য় এবং তাঁকে স্বর্গে যাবার পথে সাহায্য করে। বিয়াত্রিচে ঠিক যেন মাতা মেরির মতো পবিত্রা বলে বর্ণনা করেন দান্তে। আসলে সেই সময় ইউরোপেও ছেলে-মেয়েরা আজকের মতো তরুণ বয়সেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতো না এবং বাবা-মা’র কথায় তাদের বিয়ে করতে হতো। হয়তো দান্তেকে সেটা করতে হয়েছে এবং বিয়াত্রিচে অকাল মৃত্যু বরণ করেছেন। বিষণ্ন দান্তে বাকি জীবন কবিতা লিখে বিয়াত্রিচেকে অমর করে গেছেন। 

“সে আমার অন্তরের উজ্জ্বল নারী, অনির্বাণ রূপরাশি, সব মন্দত্বের সংহারকারিনী, পুণ্য ও নির্বাণের রাণী,” লিখেছেন দান্তে। 

মজনুন লায়লা 

আরবি ভাষায় মজনুন লায়লা শব্দদ্বয়ের অর্থ হলো ‘লায়লার উন্মাদ (প্রেমিক)।’ সপ্তম শতকে আরবের নাজদি বেদুঈন গোত্রের কবি কায়েস ইবন আল-মুল্লাওয়াহ তাঁর প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদি বা লায়লা আল-আমিরিয়াকে নিয়ে প্রথমে এই অমর কাহিনি কাব্য রচনা করেন। পরে এই কাহিনি জনপ্রিয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আরবি থেকে ফার্সি, তুর্কি এবং এমনিক ভারতীয় ভাষাগুলোতেও। তবে এই বিরহগাঁথা তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা অর্জন করে পারস্যের কবি নিজামি গজনভির হাতে- আনুমানিক ১১৮৮ খ্রিষ্টাব্দে। বৃটিশ কবি লর্ড বায়রণ এই আখ্যানকে পূর্বের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। 

মজনুন লায়লার কাহিনি আসলে কবি কায়েসের নিজের জীবনেরই কাহিনি। যাযাবর বেদুঈন গোত্রের এক চাল-চুলোহীন কবি কায়েস প্রেমে পড়েন আমির কন্যা লায়লার এবং লায়লার নামে কবিতা লিখতে শুরু করেন। কায়েসের মুখে রাত-দিন লায়লাকে নিয়ে রচিত কবিতা শুনতে শুনতে স্থানীয় মানুষেরা ঠাট্টা করে তাঁকে মজনুন বা লায়লা প্রেমে উন্মাদ বলে ডাকতে শুরু করে। আরবি ভাষায় মজনুন শব্দের অর্থ হলো পাগল বা উন্মাদ। তো এই তরুণ কবি যখন খোদ আমিরের কাছে গিয়ে মেয়ের হাত প্রার্থনা করলেন, মেয়ের বাবা তো ভয়ানক রেগে গিয়ে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। লোকে যে কবিকে পাগল ডাকছে, তার হাতে দেবেন মেয়েকে? কিছুদিন পরেই লায়লার বিয়ে হলো থাকিফ গোত্রের তাইফ নামে এক অভিজাত ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাইফ কিন্তু দেখতে খুব রূপবান ছিল এবং তার রং ছিল লালচে ফর্সা। আরবরা তাঁকে ওয়ার্দ নামে ডাকতেন। ওয়ার্দ অর্থ আরবি ভাষায় গোলাপ।

এদিকে প্রেমিকার বিয়ের খবর শুনে মজনুন পালিয়ে যায় বেদুঈন তাঁবু ছেড়ে এবং মরুভ‚ মিতে হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে। তাঁর পরিবার ছেলেকে মানসিক ভারসাম্য সমেত ফিরে পাবার আশা ছেড়ে দেয় এবং তার জন্য মরুতেই খাবার রেখে দিত। কখনো মজনুন নিজেই জোরে জোরে একা একা কবিতা পড়তেন আবার কখনো বালুতে কাঠি দিয়ে কবিতা লিখতেন। 

এদিকে লায়লাকে উত্তর আরবে চলে যেতে হলো স্বামীর সঙ্গে। তবে সে-ও বেদনার্ত মনে অসুস্থ হয়ে পড়লো এবং একসময় মারা গেল। কেউ কেউ বলে যে মজনুনকে না পেয়ে লায়লা হৃদরোগে মারা যায়। বহু পরে ৬৮৮ সাল নাগাদ, লায়লার কবরের পাশে মজনুনকে পাওয়া যায়। লায়লার কবরের পাশে একটি পাথরে জীবনের শেষ তিনটি কবিতা রচনা করে যান। ভাগ্যক্রমে মজনুনের অধিকাংশ কবিতা তাঁর মৃত্যুর আগেই তাঁর ভক্তরা লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হন। 

এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আমি, এ শহর লায়লার শহর চুমু খাচ্ছি এর দেয়ালে দেয়ালে না- এই নগরীর প্রেমে নয় বরঞ্চ এই নগরীতে বাস করা সেই একজনার জন্য। 

সত্যিই এই একজনা যে কে? সে কে? সে কি সেই যাকে বাংলার কবি ঠিক এভাবে লিখে গেছেন: আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা/আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা/আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে/ আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।

আরবে সে লায়লা, পারস্যে সে শিরিন বা শিঁরি, বৃন্দাবনে সে রাধা, ইতালীতে সে বিয়াত্রিচে, বাংলায় সে মধ্যযুগে রজকিনী আবার বাংলার রোমান্টিক যুগে সে রঞ্জনা ও ত্রিশের দশকে সে-ই হয়ে ওঠে সুরঞ্জনা-বনলতা-সুচেতনা থেকে কতজনা! সাহিত্যে এ জাতীয় প্রেমকে বলা হয় ভার্জিন লাভ বা যে প্রেমে নায়ক-নায়িকা কখনো পরস্পরকে বিয়ে করতে বা বিয়ে ব্যতীতও দৈহিক ভাবে পায়না। 

রাধা ও শ্যাম 

উপমহাদেশের মানুষের জন্য রাধা ও শ্যাম বা রাধিকা-কানাই শব্দ-বন্ধ নতুন করে ব্যাখ্যার কিছু নেই। কংসের কারাগারে জন্ম হয়েছিল দেবকীর যে অষ্টম সন্তানের, তাঁকে ঝড়-বৃষ্টির রাতে লুকিয়ে পাঠানো হয় গোয়ালা রাজা নন্দ ও তাঁর স্ত্রী যশোদার ঘরে। গোয়ালা যুবক হিসেবে বড় হয়ে ওঠা কানাই শৈশব থেকেই দুষ্টু। কৈশোর পার হয়ে যৌবনে পা রাখতে না রাখতে কানাই প্রেমে পড়েন পাশাপাশি বয়সের এক বিবাহিতা নারী রাধার। সম্পর্কে মামি ও কিংবদন্তি মতে নপুংসক আয়ান ঘোষের স্ত্রী রাধা প্রথমে কানাইকে প্রত্যাখ্যান করলেও কানহাইয়ার ক্রমাগত ও একতরফা, নাছোড়বান্দা পিছু লেগে থাকায় একটা সময়ে প্রেমে সম্মত হয়। শ্যামের অসাধারণ বাঁশিও উন্মনা করে তুলতো রাধাকে। কিন্তু তারপর? গোয়ালার ঘরে লুকিয়ে থাকা যাদব রাজপুত্রকে একটা সময় বৃহত্তর জীবন ও কর্তব্যের ডাকে চলে যেতে হয় নগরে। তিনি হয়ে ওঠেন ‘মহাভারতে’র ধর্মাধর্ম নির্ধারণের এবং একই রাজবংশের সিংহাসনের দাবিদার দুই পিতৃব্যের পুত্রদের ভেতর তথা কুরু-পান্ডব যুদ্ধের নেপথ্য ভাগ্যবিধাতা। তিনি বিয়ে করেন রুক্সিনী, সত্যভামা সহ আর্যাবর্তের গুরুত্বপূর্ণ রাজকন্যাদের। কোন্ বৃন্দাবনের তুচ্ছ গোয়ালিনী রাধার কথা ভাবার সময় কই তাঁর? এদিকে রাধা তো শ্যামের জন্যই কূল ছেড়েছেন, হয়েছেন কলঙ্কিনী। হিন্দুস্থানী রাগ সংগীতে  কখনো ‘যা রে যা রে কাগা তু/যাযারে কহিও/মোরা কহিও ইতানি সন্দেশ বা‘ কিম্বা কাককে রাধা বলেন যেন মৃত্যুর পরে তার মৃত্যুর খবর নিষ্ঠুর কানহাইয়কেত গিয়ে বলা হয়। কখনো ‘পনঘট মে চলি/ভরণ গাগরি/রোকত টোকত নন্দকিশোর মোরি/ওত চলি হু যমুনা ঘাটপে/নাহি শুনতো মেরি ইতনি বিনতি’ বা কলসে জল ভরার ছলে রাধা চলছেন যমুনায়। সেখানে কানাই আসছেন। রাধার মিনতি কি তিনি শুনছেন? শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে অবিরত যুদ্ধ করে বা তাদের লুকিয়ে রাধাকে ছুটতে হয়। শ্যামের বাঁশি বাজলেই ঝড়-বৃষ্টির ভেতরেও তাঁকে ছুটতে হয়। লক্ষ্য রাখেন যেন পায়ের পায়েল বা ঘুঙুর বেজে শব্দ না হয়, ‘ঝনন ঝনন ঝনন/ঝন বাজে পায়েলিয়া/জাগে ননদিয়া/একে ত’ বৈরী বৈঠি সাস ননদিয়া/ঔরন দুজে আঁধেরি রাতিয়া।’ চলার সময় পায়ের পায়েলের শব্দে ননদ জেগে উঠছে ঘুম থেকে। ঘরে শত্রু শাশুড়ি ও ননদিনী তো আছেই, তারপরও আছে ঘন আঁধার রাত। রবীন্দ্রনাথ ভানু সিংহ নাম নিয়ে ব্রজবুলীতে লিখছেন শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটার ভেতর রাধার অভিসারে ছুটে চলার কথা। যদিও হিন্দু ধর্মতত্ত্বে কানাইয়ের জন্য রাধার আকুলতাকে পরমাত্মা বা ঈশ্বরের জন্য জীবাত্মা বা ভক্ত কি উপাসকের আকুলতার কথা বলা হচ্ছে এবং ইরানের সূফী দর্শনে একটু ঘুরিয়ে আল্লাহ বা উপাস্যকে মাশুক বা উদ্দিষ্টা দয়িতা (লায়লা বা শিঁরি যেমন) এবং উপাসককে আশিক বা প্রেমিক (মজনুন, ফরহাদ) বলা হচ্ছ। ধর্মতত্ত্বের মোড়কে মানব-মানবীর কিংবদন্তির প্রেম আবৃত করা হলেও, হয়তো সেই মধ্যযুগে ভারতে বা আরবে-ইরানে মুকুলিত অনেক নর-নারীর ব্যর্থ প্রেমের আখ্যানগুলোই এই কিংবদন্তিসমূহে বলা হয়েছে।

সময় ও পরিসর জনিত কারণে বা আজকের পাঠক খুব দীর্ঘ লেখা পড়তে চায় না বলে এই লেখায় পারস্যের অগ্নি-উপাসক যুগের সাসানীয় রাজকুমার খসরু ও আর্মেনীয় রাজকুমারী শিঁরিকে নিয়ে লেখা কবি ফেরদৌসীর কাহিনি আর লিপিবদ্ধ করা গেল না। তবে অর্ন্তজালে পারস্যে ইসলাম ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও আজও সেদেশের নানা চিত্রকর্মে বা গালিচায় শিঁরি-খসরুর প্রথম দেখার মুহূর্ত নগ্ন উর্দ্ধাঙ্গে ও চুল মেলে দেয়া শিঁরির স্নান খসরু দেখছেন এমন বেশ কিছু ছবি দেখা গেল। সঙ্গত কারণেই বর্তমান ইরানের ইসলামী সরকার তাই সাম্প্রতিক সময়ে শিঁরি ফরহাদকে নিয়ে সেদেশে একটি নতুন বিশালায়তন গ্রন্থ প্রকাশের অনুমতি দেননি যেহেতু অতীতের কাব্যে বা চিত্রকলায় প্রাক-ইসলামী যুগের রাজকুমারী শিঁরির অনেক বসনহীনা ছবিও রয়েছে। তবে আজও সেদেশে গালিচা বা চিত্রকলায় খোলা চুলের বা কখনো কখনো বসনহীনা শিঁরিকেও দেখা যায়। বিখ্যাত তুর্কি লেখক ওরহান পামুকের ‘মাই নেম ইজ রেড’ উপন্যাসে শিঁরি-খসরুর কাহিনির এক আধুনিক পুনর্বয়ান রয়েছে তবে নায়ক খসরুর নাম তুর্কি কায়দায় বদলে তিনি করেছেন খোসরেভ। 

পৃথ্বীরাজ ও সংযুক্তা

রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান। তিনিই দিল্লির শেষ রাজপুত রাজা। ভারতীয় হিন্দু রাজাদের ভেতর অনৈক্য ও আপন শ্বশুরের শত্রুতার কারণে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তার পরাজয়ের মাধ্যমেই দিল্লিতে মুসলিম শাসন শুরু হয়। বিজয়ী মুহাম্মদ ঘুরী দিল্লিতে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন আর পরাজিত পৃথ্বীরাজ চৌহানের মৃত্যু হয়, তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী সংযুক্তা বেছে নেন জহরব্রতে আত্মদানের পথ। অথচ পৃথ্বীরাজ ও সংযুক্তার প্রেম সূচিত হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। চলুন, শুনি সেই কাহিনি। 

দ্বাদশ শতাব্দীর চৌহান বংশের রাজা পৃথ্বীরাজ কনৌজের রাজা জয়চাঁদ এর কন্যা সংযুক্তার রূপের গল্প শুনেছিলেন লোকমুখে। আবার দিল্লি ও আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের অসি চালনা ও তীরন্দাজির সুনাম ছিল ভারতবর্ষ জুড়ে। কনৌজের রাজা জয়চাঁদ পৃথ্বীরাজ চৌহানের এই খ্যাতি মানতে পারতেন না। পৃথ্বীরাজ এবং জয়চাঁদ কিন্তু একে অন্যের আত্মীয় ছিলেন। এদিকে রাজকবি চান্দ বারদাই পৃথ্বীরাজের বন্ধু ছিলেন। অন্যদিকে রাজকন্যা সংযুক্তারও একজন সখী ছিল। তার নাম চাকোরী বা মতান্তরে মদনা। মদনা একদিকে বান্ধবী, সেবিকা আবার দরকারে তরবারি ঘোরানো ও ঘোড়ায় চড়তেও ছিল দক্ষ। 

মদনার মুখেই সংযুক্তা পৃথ্বীরাজ চৌহানের রূপ, যৌবন এবং বীরত্বের কথা জানেন। দিনের পর দিন পৃথ্বীরাজের গল্প শুনতে শুনতে রাজকন্যার পৃথ্বীরাজকে দেখতে চান। উল্টোদিকে পৃথ্বীরাজও সংযুক্তাকে দেখার কথা ভাবেন। দুজনের প্রথম দেখা হয় কোটেশ্বর মন্দিরে। প্রথমে দুজনেই ছদ্মবেশে পরস্পরকে দেখেন। তবে আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্ক গাঢ়তর হয়। পৃথ্বীরাজের হয়ে ব্রজবুলি ভাষায় প্রেমপত্রগুলো রচনা করতেন স্বয়ং রাজকবি চান্দ বারদাই। প্রশিক্ষিত পায়রার মাধ্যমে সেই পত্র পৌঁছে যেত কনৌজ রাজকন্যার হাতে। কিন্তু একদিন পৃথ্বীরাজ এবং সংযুক্তার প্রেম রাজা জয়চাঁদ জানতে পারলে দ্রুতই তিনি রাজকন্যার স্বয়ংবর সভা ডাকেন। ভারতের অনেক রাজাকে নিমন্ত্রণ করা হলেও পৃথ্বীরাজকে কোনো আমন্ত্রণ পাঠানো হলো না। তার বদলে রাজসভায় ঢোকার মুখে পৃথ্বীরাজের একটা মূর্তি বানিয়ে রাখা হলো। কিন্তু তেজস্বিনী সংযুক্তা জীবন্ত রাজপুত্রদের বাদ দিয়ে পৃথ্বীরাজের মূর্তির গলায় মালা দিলেন আর পৃথ্বীরাজ ওই মূর্তির আড়ালেই লুকিয়ে ছিলেন এবং সংযুক্তাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে ছুটলেন। কনৌজ সেনারা তাদের ধাওয়া করেও যুদ্ধে হেরে গেল পৃথ্বিীরাজ ও অদূরে তাঁর জন্য অপেক্ষারত চৌহান বাহিনীর কাছে। 

কিন্তু পৃথ্বীরাজ ও সংযুক্তার প্রেমকাহিনি এখানেই শেষ নয়। ইতোপূর্বে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে ১১৯১ সালে পরাজিত হয়ে আফগানিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন মুহাম্মদ ঘুরী। প্রতিশোধ নেয়ার আগুন ঘুরীর মনে আগে থেকেই ছিল। সেই প্রতিশোধের আগুন দ্দিবগুণ করলেন পৃথ্বীরাজের শ্বশুর জয়চাঁদ। তিনি ঘুরীকে দিল্লি জয়ের আহবান জানান ও মুহাম্মদ ঘুরীও তখন পুনর্বার ভারত আক্রমণে আসেন। দেশপ্রেমিক রাজা পৃথ্বীরাজ ভারতের সব রাজ্যকে সাহায্যের অনুরোধ করলেও শ্বশুর আগেই সবাইকে সহায়তা থেকে বিরত থাকতে সম্মত করিয়েছেন। 

কিন্তু অন্য রাজপুত রাজাদের অসহযোগিতার কারণে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে হেরে গেলেন পৃথ্বীরাজ ও তাঁকে হত্যা করা হয়। আর স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ রানী সংযুক্তাও আলিঙ্গন করলেন জহরব্রতের আগুন। সংযুক্তার বাবা জয়চাঁদ নিশ্চিত তখন খুশি হয়েছিলেন?

আনারকলি ও সেলিম 

আনারকলি  ছিলেন একজন দাসী কন্যা। জন্ম সূত্রে তাঁর আসল নাম ছিল নাম নাদিরা বেগম। অনুমান করা হয় যে আনারকলি কোনো এক বণিক বহরের সঙ্গে ইরান থেকে পাঞ্জাব অঞ্চলের লাহোরে (বর্তমান পাকিস্তান) অভিবাসিত হয়েছিলেন। বলিউডের চির সবুজ চলচ্চিত্র মুঘল-ই-আজমে আনারকলিকে মুঘল আমলে শাহজাদা সেলিমের সঙ্গে (যিনি পরবর্তিতে জাহাঙ্গীর হয়েছিলেন) অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের অপরাধে মোগল সম্রাট আকবরের নির্দেশে দুটি ইটের দালানের মধ্যখানে জীবন্ত কবরস্থ করা হয় বলে দেখানো হয়েছে।

‘আনারকলি’র সম্বন্ধে প্রথম জানা যায় ইংরেজ পর্যটক ও বণিক উইলিয়াম ফিঞ্চের সাময়িকী থেকে, যিনি আগস্ট ২৪, ১৬০৮ সালে ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। বাস্তবে ‘আনারকলি’ নামে কেউ না থাকলেও বলিউডের অপরূপা সুন্দরী নায়িকা মধুবালা ও তাঁর কন্ঠে লতা মুঙ্গেশকরের গান উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। 

চণ্ডীদাস-রজকিনী

চণ্ডীদাস বারো বছর ধরে রোজ পুকুর ঘাটে বড়শিতে মাছ ধরতে আসেন তবে মাছ পান না। আর ওদিকে বারো বছর ধরে রজকিনী রোজ পুকুর ঘাটে আসেন, কাপড় কাচেন, জল তোলেন, বেচারা চণ্ডীদাসের দিকে ফিরেও তাকান না। চণ্ডীদাস বসে থাকেন গভীর ধৈর্যে, পরম আশায়। একদিন সেই রামী রজকিনীর মনে অনুকম্পা দেখা দিলো অথবা নিছকই কৌতূহলে প্রশ্ন করলেন, মাছ দুই একটা মিললো ঠাকুর? চণ্ডীদাসের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর, এইমাত্র ঠোকর দিলো!

নিষ্কাম প্রেমের আদর্শ এই কিংবদন্তি বাস্তব না শুধুই গল্প কে জানে! তবে বাংলা কাব্যে সত্য হয়ে আছে চণ্ডীদাস রচিত ‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে/কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকূলে/আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন/বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রান্ধন’’অমূল্য সব পদ।

চণ্ডীদাস নামে কেউ কি সত্যিই ছিলেন? বাংলা সাহিত্যে বুড়ো চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস আর অনন্ত বুড়ো চণ্ডীদাস নামে তিন জনের পদ পাওয়া যায়। কাজেই এই নিয়ে ‘চণ্ডীদাস সমসা’ নামে বাংলা সাহিত্যে একটা সমস্যাই আছে। তবে গবেষণা করে শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন চতুর্দশ শতকের কবি বুড়ো চণ্ডীদাসের রচিত। তিনি বীরভূমের নান্নুর গ্রামের অদূরে তোয়াই গ্রামের বাসুলীদেবী মন্দিরের সেবক ছিলেন। সেই মন্দিরের চিহ্ন আজও রয়ে গেছে। বাংলার চণ্ডীদাস ও রজকিনীর নিষ্কাম প্রেম ও প্রতীক্ষার তুল্য হয়তো আর ইতালির দান্তে ও বিয়াত্রিচে। আজ আপাতত এতটুকুই।