সাতসতেরো

বিভিন্ন স্থানে বিহারিদের সঙ্গে বাঙালীর তুমুল সংঘর্ষ

একাত্তরের ২০ মার্চ ছিল শনিবার।  লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ১৯তম দিন।  আজো রাজধানীর সব সরকারি-বেসরকারি বাসভবন এবং যানবাহনে কালো পতাকা উড়ছে।

এইদিন বিহারি ও পাক সেনাদের সঙ্গে বাঙালীর তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে।  আহত হয় অর্ধশতাধিক।

বঙ্গবন্ধু যে সব অফিস খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেগুলো ছাড়া আর সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বর্জন কর্মসূচী পালিত হয়।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগের সমর্থনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগানে ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথ আগের মতোই প্রকম্পিত থাকে।

সকাল ১০টায় জেনরেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৪র্থ দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।  বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, খোন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং ড. কামাল হোসেন।

ইয়াহিয়ার সঙ্গে ছিলেন বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান।  আজকের আলোচনা প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়।  

গতকালের জয়দেবপুরের ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিপুলসংখ্যক জনসমাবেশ ঘটে।

বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন হতে বঙ্গবন্ধু বের হয়ে এলে সংগ্রামী জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে নেতাকে স্বাগত জানায়।  পরে ধানমন্ডির বাসভবনে ফিরে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের আলোচনা অব্যাহত আছে।  আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।  আগামীকাল পুনরায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসব।  ইতোমধ্যে আমার উপদেষ্টাগণ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে সময় ঠিক করে মিলিত হবেন।’

আলোচনায় তিনি সন্তুষ্ট কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে, আমার এ মন্তব্য হতেই আপনাদের বুঝে নিতে হবে।’

কতদিন এ আলোচনা চলবে- এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আলোচনা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না।’

এদিকে প্রতিদিনের মতো আজো রাজধানীর বিভিন্ন স্থান হতে বিপুল জনতা শোভাযাত্রা সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমবেত হয়।  প্রতিটি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে একের পর এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার জনগণের সার্বিক মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সত্যাগ্রহ চলবে।  আন্দোলনে ভাটা পড়তে দেবেন না।  সংগ্রামে শৈথিল্য আসলে শত্রুপক্ষই শক্তিশালী হবে।  আমার আর কিছুই পাওয়ার নেই, যা আমি পেয়েছি এর কোন তুলনা নেই। বাংলার মানুষের এই বিশ্বাস ভালবাসা নিয়েই আমি মরতে চাই।  আর তার আগে বাংলার মানুষের মুক্তি চাই।  যত বাধাই আসুক এই লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশকে কলোনি করে বাজার করে রাখার দিন বাসি হয়ে গেছে।  মুক্তিপিপাসু সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয়কে পৃথিবীর কোন শক্তিই প্রতিহত করতে পারবে না।’

মিছিলকারীদের মধ্যে ছিল ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশনের কর্মচারী, ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মচারী, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী, প্রাদেশিক সরকারের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী ও সেটেলমেন্ট কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন।

অসাধারণ প্রাণশক্তি আর অদম্য মনোবল নিয়ে জনতার সংগ্রামী মিছিলের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর অগ্নিঝরা বক্তব্য প্রদান করছিলেন।  

একাত্তরের ২০ মার্চ ছিল ঘটনাবহুল উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন।  আন্দোলনে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।  তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। এবারের সংগ্রাম প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর ও গ্রামে।  আবালবৃদ্ধবনিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ, সারা বিশ্বের স্বাধীন জাতি কীভাবে স্বীয় লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’

এদিনই বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি দিয়ে ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উপলক্ষে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন।  

একাত্তরের এই দিনে ছাত্র ইউনিয়ন এক ভিন্ন রকমের কর্মসূচী পালন করে।  তাদের উদ্যোগে গঠিত গণবাহিনী ১০ দিনের প্রশিক্ষণ শেষ করে রাজপথে এক শোভাযাত্রা বের করে।  এতে প্রতিটি সদস্য সেদিন ডামি রাইফেল নিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন।  ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ।  তার নেতৃত্বে এ শোভাযাত্রা বের হয়।