সাতসতেরো

ডুপ্লেক্স বাসা বানায় ছোট নীলচটক পাখি

বার্ড ফটোগ্রাফারদের কাছে নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত পাখির ছবি তোলার আগ্রহ বেশি থাকে। কারণ এ ৬ মাস দেশের এবং পরিযায়ী পাখির বিচরণ চোখে পড়ে। নতুন পাখির খোঁজে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে প্রতি বছর ৮-৯ বার যাই। বেশির ভাগ বার্ড ফটোগ্রাফার ফেব্রুয়ারির শেষে এবং মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ বেছে নেন। এই দুই মাস সাতছড়ি বনে পাখিদের খাবার পানির অভাব দেখা দেয়। বনের ভেতর দুটি ছোট ডোবা আছে। সেখানে পরিযায়ী পাখিরা দিনের বিভিন্ন সময় পালা করে পানি পান ও গোসল করতে আসে। তাই ফটোগ্রাফাররা সহজেই পাখির দেখা পান।

এ বছরের ১ মার্চ সাতছড়ি গিয়েছিলাম। ভোরে বনের ভেতর পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠলাম। পাখির ছবি তুলে বেলা ১২টায় টাওয়ার থেকে নেমে রুমে চলে আসি। দুপুরের খাবার খেয়ে বেলা ৩টায় রাস্তার ধারে নতুন ডোবায় গেলাম। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অনেক ফটোগ্রাফার। দেখে মনে হলো এ যেন ফটোগ্রাফারদের মিলনমেলা। আমি সুবিধামত একটি জায়গায় বসে পড়লাম। নানা প্রজাতির পাখি গোসল করার জন্য ডোবায় নামছে। চারদিকে ক্যামেরার সার্টার পড়ার শব্দ। দূর থেকে শুনলে মনে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে গোলাগুলি হচ্ছে।

এদিন এখনে ছোট প্রজাতির বিভিন্ন পাখির ছবি তুলছিলাম। এমন সময় অচেনা ও নাম না-জানা একটি পাখি উড়ে এসে একটি গাছের সরু ডালে বসলো। পাখিটি আমার নজরে পড়লো। কয়েক সেকেন্ড পর ডোবার ধারে মাটিতে নেমে এলো। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা তাক করে অনবরত ক্লিক করলাম। পরে পাখিটির পরিচয় জানলাম। পাখিটির নাম ছোট নীলচটক বা ছোট নীলমনি।

এটি Niltava গোত্রের Muscicapidae পরিবারের ১১- ১৩ সে.মি. দৈর্ঘ্য এবং প্রায় ১৪ গ্রাম ওজনের পাখি। এর চোখ  বাদামি। পূর্ণবয়স্ক পুরুষপাখির পিঠ কালচে নীল। মাথার চাঁদির সামনের অংশ, ঘাড়ের পাশ, কোমর, লেজ ও কপাল নীল রঙের। গলা গাঢ় বেগুনে-নীল। তলপেট সাদা। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েপাখির পিঠ কালচে জলপাই-বাদামি। দেহের নিচের অংশ লালচে। ডানা ও লেজ লাল। উভয়ের চোখ বাদামি। ঠোঁট কালো। পা ও পায়ের পাতা হালকা বাদামি।

ছোট নীলচটক গ্রীষ্ম মৌসুমে জলধারার পাশের ঝোপ-ঝাড়, চিরসবুজ বনের গাছের নিচে জন্মানো গুল্মলতা ও বনের ভেতর ছোট ছোট ঝোপে বিচরণ করে। শীত মৌসুমে সমতলের ঘাস ও নলবনে বিচরণ করে। শীতে এরা একা একা ঘুরে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে পিঁপড়া, গুবরে পোকা ও অন্যান্য পোকা। তবে শীতকালে বনের রসালো ফলও খেতে দেখা যায়। ভোরবেলা এরা কর্মচঞ্চল থাকে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের ছায়ায় বা ঝোপের ভেতরে চলে যায়। এপ্রিল থেকে জুলাই মাস এদের প্রজননকাল। প্রজনন মৌসুমে নদীর পাড়ে শ্যাওলা দিয়ে ডুপ্লেক্স বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখি ৪-৬টি ডিম পাড়ে। দুজনে মিলে ডিমে তা দেয়। সংসারের যাবতীয় কাজ দুজনে মিলে করে। এদের চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো মাঝে মাঝে এরা পাপিয়ার ডিমে তা দিয়ে ছানাদের লালন-পালন করে।

ছোট নীলচটক আমাদের দেশের পাখি। শীতে সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনে দেখা যায়। এ ছাড়া ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও ইন্দোচীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। ছোট নীলচটক বিশ্বের বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। এ প্রজাতিকে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত করা হয়নি।

ইংরেজি নাম: Small Niltava বৈজ্ঞানিক নাম: Niltava macgrigoriae ( Burton, 1836)