সাতসতেরো

পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর যত মহামারি

মানবজীবনের নিত্যসঙ্গী হুমকি। হুমকি মোকাবিলা করেই মানুষ যুগের পর যুগ টিকে আছে এবং সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। মানুষের এই অব্যাহত প্রচেষ্টাকে যোসেফ আরনল্ড টয়েনবি তাঁর A Study of History গ্রন্থে হুমকি ও মোকাবিলা বা প্রতিকূলতা ও মোকাবিলা তত্ত্ব (The theory of Challenge and Response) আকারে বিশ্লেষণ করেছেন।

হুমকির মধ্যে মহামারি একটি। প্রাগৈতিহাসিক কালেও মহামারি ছিল। অর্থাৎ মানুষের ইতিহাস যত দিনের মহামারির ইতিহাসও তত দিনের। কখনো প্লেগ, ম্যালেরিয়া, গুটি বসন্ত, কুষ্ঠ রোগ, কখনো যক্ষ্ণা, কালা জ্বর, কলেরা, সার্স, মার্স, কোভিড প্রভৃতি রূপে প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে। মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। আবার মানুষ ওষুধ, টিকা উদ্ভাবন করে সেগুলোকে মোকাবিলাও করেছে। পৃথিবীতে কতিপয় মহামারির কথা জানা যায় যেগুলো ধ্বংসাত্মক কর্মের জন্য বিশ্ব ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ববিদগণ উত্তরপূর্ব চীনের হামিন সংঘ নামক এক স্থানে প্রায় ৫০০০ বছর আগের ১৪ ফুট বাই ১৫ ফুট আকৃতির একটি ঘরের সন্ধান পান। সেটি ছিল গণকবর। সেখানে শত শত নারী, পুরুষ, যুবক, শিশু, বৃদ্ধের কঙ্কাল, জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। উত্তরপূর্ব চীনের মিয়াজিগৌ নামক স্থানে সমসাময়িক আরেকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, মহামারির কারণে লোকগুলো মারা গেছে। 

শিল্পীর তুলিতে এশিয়াটিক কলেরার চিত্র

৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিসে মহামারি দেখা দেয়। এর নাম নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কারো মতে এটি প্লেগ, কারো মতে টাইফয়েড, কারো মতে ইবোলা। গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডিডিস (৪৬০-৪০০ খ্রিস্টপূর্ব) ‘পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ’ গ্রন্থে এ রোগের লক্ষণ তুলে ধরেছেন। স্পার্টা এথেন্স আক্রমণ করেছে এবং এথেন্সবাসীকে একটা দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। লোকজন সুস্থই ছিল। হঠাৎ তারা জ্বর, মাথা ধরা, গলা, জিহবা, চোখ ফুলে লাল হয়ে ওঠা প্রভৃতি লক্ষণ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে আর মারা যায়। পাঁচ বছর পর্যন্ত এ মহামারি বিদ্যমান ছিল এবং তা লিবিয়া, ইথিওপিয়া, মিশরে ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়।

১৬৫ খ্রিস্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যে এন্টোনাইন প্লেগ নামে এক মহামারি দেখা দেয় যা ১৮০ খ্রি. পর্যন্ত বহাল থাকে। এটা ছিল এক ধরনের গুটি বসন্ত যা হুনদের মধ্যে দেখা দেয়। হুনদের দ্বারা জার্মানরা আক্রান্ত হয়। জার্মানদের দ্বারা রোমানরা আক্রান্ত হয়। পার্থিয়া যুদ্ধে রোমানরা জয়ী হয়েও পরাজয় হয় মানে সেখান থেকে রোমান সৈন্যরা রোগটি বহন করে রোমে প্রত্যাবর্তন করে। সম্রাট মারকিউস অরেলিয়াস নিজেও আক্রান্ত হন। পঞ্চাশ লাখ লোক মহামারিতে মারা যায়। ২৫০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় সাইপ্রিয়ান প্লেগ এবং তা চলে ২৭১ খ্রি. পর্যন্ত। তিউনিসিয়ার এক খ্রিস্টান ধর্মযাজক বিশপ সেইন্ট সাইপ্রিয়ানের নাম অনুসারে এ প্লেগের নাম হয় সাইপ্রিয়ান প্লেগ। প্রত্নতত্ত্ববিদগণ তিউনিসিয়ায় তিনটি চুল্লির সন্ধান পান যেখানে গণহারে প্লেগরোগে মৃত ব্যক্তিদের দাহ করা হতো। এতে ৫০০০ এর অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

৫৪১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে বিউবনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। একে জাস্টিনিয়ান প্লেগও বলা হয়। সম্রাট জাস্টিনিয়ান নিজেও আক্রান্ত হন, কিন্তু বেঁচে যান। মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগর থেকে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত ছিল তাঁর সাম্রাজ্য। প্লেগ তাঁর সাম্রাজ্যকে বিধ্বস্ত করে দেয়। বিশ্বের ১০ শতাংশ লোক মারা যায়। মহামারির পর জাস্টিনিয়ানের সাম্রাজ্য অর্থ সংকটে পড়ে এবং তা সংকুচিত হয়। তিনি কনস্টান্টিনোপলে আজকের ইস্তাম্বুলে হাগিয়া সোফিয়া গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন।

১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে দেখা দেয় ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ এবং তা বহাল থাকে ১৩৫৩ খ্রি. পর্যন্ত। ব্ল্যাক ডেথ প্লেগের কারণে ইউরোপের এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা য়ায়। এত মানুষ মারা যেত যে, কবর দেওয়ার মানুষ পাওয়া যেত না। তখন বাধ্য হয়ে গণকবর দেওয়া হতো। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। প্লেগের পর ইউরোপে শ্রমিকের চাহিদা ও মজুরি বেড়ে যায়। তখন বিজ্ঞানীরা শ্রমিকের বিকল্প কী করা যায় সে দিকে লক্ষ্য রেখে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

১৪৯২ সালে কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকা আবিষ্কারের পরে ষোলো শতকে ইউরোপীয়রা আমেরিকার ক্যারিবীয় অঞ্চলে গুটি বসন্তের জীবাণু ছেড়ে দেয়। এতে আজটেক সভ্যতা, আজটেক জাতি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৫০১ সালে হিস্পানীয় দ্বীপে লোক সংখ্যা ছিল ৬০০০০। ১৫৩৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৫০০ জনে। ইউরোপীয়ানরা নির্মমভাবে আমেরিকার আদিবাসীদের হত্যা করে তাদের দেশ, সম্পদ দখল করে। অথচ তারা আজ সাধু! নির্মম পরিহাস! ১৬৬৫-১৬৬৬ সালে লন্ডনে আবারও ব্ল্যাক ডেথের প্লেগ দেখা দেয়। তাতে লন্ডনের এক লক্ষ লোক মারা যায়, যা ছিল লন্ডনের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। ১৭২০-১৭২৩ সালে ফ্রান্সের মার্সাই বন্দর ও আশেপাশের এলাকায় প্লেগ রোগে এক লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে।

১৭৫৭-১৭৭২ সময়ের রাশিয়ার রাজধানী মস্কো শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। লৌহ মানবী দ্বিতীয় ক্যাথারিন তখন রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী। তিনি কঠোর কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। তারপরেও লক্ষাধিক লোক মারা যায়। ১৮১৭ সালে পানিবাহিত জীবাণুর কারণে রাশিয়ায় প্রথম কলেরা মহামারি দেখা দেয়। এতে রাশিয়ায় এক মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। রাশিয়া থেকে ব্রিটিশ সৈন্যরা কলেরার জীবাণু বহন করে ভারতে আসে। ভারতে কলেরার বিস্তার ঘটতে থাকে এবং লক্ষ লক্ষ লোক মারা যেতে থাকে। ব্রিটিশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে ভারত থেকে কলেরা সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে, স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। ১৮৮৫ সালে কলেরার টিকা আবিষ্কার হলেও এটি নিয়ন্ত্রণে আসতে আরো বহু সময় লাগে।

১৮৫৫ সালে চীনে প্লেগ হয় এবং তা হংকং, তাইওয়ান, ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেড় কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনী রানী ভিক্টোরিয়ার উপহার নিয়ে ফিজি থেকে অস্ট্রেলিয়া যায়। তখন অস্ট্রেলিয়ায় হামের প্রাদুর্ভাব চলছে। অস্ট্রেলিয়া থেকে রাজকীয় বাহিনী ফিজি দ্বীপে প্রত্যাবর্তন করলে সমগ্র ফিজিতে হাম ছড়িয়ে পড়ে। এতে ফিজির এক তৃতীয়াংশ (৪০০০০) মানুষ মারা যায়। ১৮৮৯ সালে প্রথম ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে সাইবেরিয়া ও কাজাখস্তানে। সেখান থেকে মস্কো, মস্কো থেকে ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ড, তারপর ইউরোপে। ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৯০ সালে এটি শেষ হয়, তবে তা ৩৬০০০ লোকের প্রাণ কেড়ে নেয়। 

প্লেগ অব মার্সেই। এই মহামারিতে লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে 

১৯১৮ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে চলেছে, সে মুহূর্তে দেখা দেয় আরেক দুর্যোগ-মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু । ফ্লুটির উৎপত্তি স্পেনে নয়। অথচ এটি স্প্যানিশ ফ্লু নামে অভিহিত। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় স্পেন ছিল নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাদের সংবাদপত্রের উপর সেনসর ছিল না। স্পেনের রাজপরিবার ফ্লুতে আক্রান্ত হলে স্পেনের সংবাদপত্রগুলো ফলাও করে তা প্রচার করে। ফলে এর নাম হয়ে যায় স্প্যানিশ ফ্লু। এর উৎপত্তি স্থল নিয়ে বিতর্ক আছে। কারো মতে চীন, কারো মতে যুক্তরাজ্য, কারো মতে যুক্তরাষ্ট্র এর উৎপত্তি স্থল। সৈনিকদের মাধ্যমে এটি ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২০ সালের এপ্রিলে এটি শেষ হয়। এতে ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইউরোপের দেশগুলো এ বিষয়ে তেমন মনোযোগ দিতে পারেনি। আবার যুদ্ধের কারণে দেশগুলো এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত, তারপরে আরেকটি মহামারি প্রচার করে আতঙ্ক ছড়াতে চায়নি। সতর্কতা ও প্রতিষেধক ওষুধের অভাবে এর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ভয়াবহ।

১৯৫৭ সালে হংকং থেকে যে ফ্লু শুরু হয় তার নাম এশিয়ান ফ্লু। এটি চীন, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রাদুর্ভাব ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত থাকে। এতে ১১ লক্ষ লোকের প্রাণ যায়। টিকা আবিষ্কার হলে মানুষ নিস্তার পায়। ১৯৮১ সালে ধরা পড়ে এইডস রোগ। আমেরিকার সমকামীদের মধ্যে প্রথম এ রোগ চিহ্নিত হয়। ধারণা করা হয় ১৯২০ এর দশকে পশ্চিম আফ্রিকার শিম্পাঞ্জির ভাইরাস থেকে এইডসের উৎপত্তি হয়। আফ্রিকা এখনো এইডসের ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিনষ্ট করে দেয়। এইডসের প্রতিবিধান আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলছে। এ রোগে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন কোটি মানুষ মারা গেছে।

২০০৩ সালে সার্স, ২০০৯-২০১০ সালে সোয়াইন ফ্লু, ২০১৪-২০১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং বেশ কিছু মানুষ মারা যায়। এরপরে আসে কোভিড-১৯ নামে মহাদুর্যোগ সৃষ্টিকারী করোনা মহামারি। এর উৎপত্তি ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান প্রদেশে। করোনার কারণে বিশ্বে এ পর্যন্ত ৪০ লক্ষ লোক মারা গেছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। কবে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে, কবে মানুষ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে কে জানে? তবে আশা করা যায়- করোনার টিকা আবিষ্কার হয়েছে। হয়ত একদিন এ মহাদুর্যোগ কেটে যাবে। 

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ