সাতসতেরো

তাকে ভোলা যাবে না

‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘পীচ ঢালা এই পথটারে ভালবেসেছি’, ‘ও রে নীল দরিয়া’, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি’, ‘বন্ধু তুমি শত্রু  তুমি’, ‘বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা’, ‘তুমি আছো সবই আছে’, ‘তারা ভরা রাতে’, ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই’- কোথাও গানগুলো বেজে উঠলে অনেকেই আজো শুনতে দাঁড়িয়ে যান। 

বলেন, আহা কী দরদে গেয়ে গেছেন আবদুল জব্বার। যতদিন এসব গান বাজবে তাকে ভোলা যাবে না। আর যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এসব গান বাজবে।

এই শিল্পীর আরো অনেক গানই কালজয়ী।  প্রথমে উল্লেখিত তিনটি গানই ২০০৬ সালের মার্চ মাস জুড়ে বিবিসি বাংলার আয়োজনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা ২০ গানের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।

কিংবদন্তী এই শিল্পীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ।  ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

আবদুল জব্বার ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠশিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।  হারমোনিয়াম হাতে গান গেয়ে আবদুল জব্বার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতার বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেন।  

মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও ছিল একটি বিশেষ সেক্টর। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে, প্রেরণা যোগাতে ও মনোবল বাড়াতে কণ্ঠযোদ্ধাদের অবদান ভুবনবিখ্যাত।

শিল্পীরা তাদের কণ্ঠ দিয়ে লড়েছিল পাকসেনাদের বিরুদ্ধে। মুক্তিসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে তাদের উজ্জীবিত করেছিল, সাহস যুগিয়েছিল শরণার্থীদের।  আবদুল জব্বার ছিলেন এই বিশেষ সেক্টরের উল্লেখযোগ্য একজন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় বলিষ্ঠ অবদান রেখেছেন। এর আগে ষাটের দশকের শেষদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা গ্রেপ্তারের সময় থেকে প্রতিবাদী গণসংগীতে কণ্ঠ দিয়েছেন। বিষয়টি আবদুল জব্বারকে ইতিহাসে অনন্য করে রেখেছে।

ওই সময় থেকেই স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে থাকেন তিনি। ওই সময় প্রতিবাদী গান ‘তুমি কি দেখেছ বন্ধু আইয়ূবের পরাজয়’, ‘শহরবাসী শোন’, ‘তোমরা যাদের মানুষ বল না’র মতো গানগুলোর মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এই সময় থেকেই শেখ মুজিব পরিবারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে তার।

১৯৬৯ সালে ‘বিমূর্ত’ নামের একটি সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন আবদুল জব্বার। একই সময়ে তিনি গঠন করেন ‘বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী’, যার সভানেত্রী ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

এই শিল্পীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায়।  গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান বেতারে। ১৯৬২ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন। ১৯৬৪ সাল থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) নিয়মিত গায়ক হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।  

বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত গেয়ে পাওয়া ১২ লাখ রুপি স্বাধীন দেশের সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেছিলেন এই গুণী শিল্পী। নিজে জনমত সৃষ্টির পাশাপাশি ১৯৭১ সালে মুম্বাইয়ে ভারতের প্রখ্যাত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিরলসভাবে কাজ করেছেন তিনি।

সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে একুশে পদক ও ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি।  এছাড়া বাচসাস পুরস্কার, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস- আজীবন সম্মাননা, জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আরো অনেক পুরস্কার লাভ করেন।