সাতসতেরো

ট্রাভেল উইথ ট্রাবলস

প্রকৃতি সবসময়ই প্রকৃত, আদি এবং আসল। গতবছর গ্যালেংগার তাইমাতং রিসোর্টের লালমাটির লেপা উঠোনে চেয়ারে হেলান দিয়ে দেখছিলাম এক অপরূপ নিসর্গ। আকাশ ছোঁয়া গর্জন, চাপালিশ, তেলসুর, বৈয়ম গাছের উর্বশী পাতার ফাঁক গলে কিশোরী চাঁদের মোলায়েম আলো গলে গলে পড়ছিল কাঠবাদামের লাল-সবুজের সিল্কি পাতায়। যেন আদর বুলিয়ে দিচ্ছিল পাতাদের নরম শরীরে। তখন মনে হয়েছিল এটাই প্রকৃতি, এটাই প্রকৃত।

এই বোধটা আমার আরেকবারও হয়েছিল, সেটা অযোধ্যা পাহাড়ে। শাল, মহুয়া, শিমুল, পিয়ালের জঙ্গলে পাতাদের ঠাস বুনটে সূর্যের রশ্মিটাও মাটিতে পৌঁছাতে না পারার দৃশ্যটা দেখে! মরুভূমিতে অথবা পাথুরে পাহাড়ে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে যতই সবুজের জমায়েত ঘটাক, যতই গ্রিন হাউজ বানানো হোক না কেনো, প্রকৃতির কাছে সেসব অফসেটের গায়ে বসা অক্ষর থেকে খসে যাওয়া জেরক্স কপির মতোই। আসলের নকলই শুধু কিন্তু আসল একেবারেই আসল। তেমনি এক প্রকৃতির স্বাদ পাই গ্রামের বাড়ি গেলে। তাই তো, তার কোলের ওম নেওয়ার লোভে ছুটে যাই কারণে-অকারণে। এবার গিয়েছিলাম একেবারেই নিছক আর অকারণেই।

বিউটি বৌদির ঘরে নতুন বাসিন্দা এসেছে। বিদেশি গাঁই, ওলান ভরা দুধ, কামধনুর মতো দুধের আঁধার। যতবারই বাড়ি যাই, নানা বাহানায় একটা না একটা ব্যাগ বা বস্তা গছিয়ে দেবেনই। আজ কাঁঠাল তো কাল নারকেল। পরশু সজনেডাঁটা তো তরশু আতাফল-সরিফা। এবার দিতে চেয়েছিলেন নিজের গরুর দুধ। আমি প্রায় পালিয়েই এসেছি।

বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ কিলো দূরে বাসস্ট্যান্ড। একটা অটো ধরে যাত্রা করলাম। পিচঢালা পথ খানিকটা সর পড়া দুধের মতোই। কোথাও কোথাও বেশ মসৃণ কোথাও আবার ইয়া বড় গর্ত। গর্তগুলো দেখলে মনে হয় নিশুতি রাতে দেও-দানবরা নেমে এসে খাবলা খাবলা পিচ তোলে তিনারা দন্ত মাজন করেন নিয়মিত, নতুবা প্রতিদিনই গর্তের সংখ্যা আর গভীরতা বাড়বে কেন!

আমার অটোটা যখন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালো, দেখলাম একটা বাস পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মতো করে স্ট্যান্ডের পেছনের পথ দিয়ে বের হলো, ভাবলাম, যাক-আমি পরেরটায় যাবো। কিন্তু কাউন্টারে গিয়ে বুঝলাম, বাসটা ছেড়ে দিয়ে আমার আক্কেল-গুড়ুম হয়ে গেছে। ওরা জানালো, যে বাসটা বেরিয়ে গেলো ওটাই ‘লাস্ট ট্রিপ’। সন্ধ্যা ৬টার বাস। একটু জোরে দৌড়ালেই ধরতে পারবো। অগত্যা কাঁধের ব্যাক প্যাক নিয়ে দিলাম দৌড়। আমি এগোই বাস এগোয়। দূরত্ব একটু বেশি হলেও ভরসায় ছিলাম বাস ধরতে পারবো। কারণ, সামনেই একটা বেইলি ব্রিজ, ওখানে গেলে পাবোই। কিন্তু পান্তা ভাতে ঘি এর মতো একটা অ্যাম্বুলেন্স বিকট সাইরেন বাজিয়ে আমার সামনে এসে বেড়া হয়ে দাঁড়ালো। অ্যাম্বুলেন্সকে পাশ কাঁটিয়ে তাকিয়ে দেখি, ততক্ষণে আমার আর বাসের মধ্যকার দূরত্ব বেড়েছে বেশ। পায়ে হেঁটে ধরা অসম্ভব। তবে বাসের পশ্চাদদেশ দেখতে পারছিলাম।

একটা ব্যাটারিচালিত রিকশা এসে দাঁড়ালো উদ্ধারকর্তার মতো। কেতাদুরস্ত প্যান্ট-শার্ট পরিহিত, ডান হাতের কবজি ঘড়ি বেষ্টিত যুবক। বাসটা ধরে দেওয়ার শর্তে চড়ে বসলাম। মনে মনে ভরসা করলাম, ঘড়ি যেহেতু আছে, সময়ের টানটা সে বুঝবে ভালোই। কিন্তু কোথায় কী! প্রতি ঝাঁকিতে একবার করে ঘড়ি দেখেন। এদিকে বাসটা চলে গেলো আমাদের দেখার দূরত্বের কিঞ্চিৎ বাইরে। ঘড়িওয়ালা পাইলট ছোটখাটো গর্তেও পরম আদরে রিকশাটা চালাচ্ছেন। ব্রেক কষছেন নতুন বউকে আদর করার মতো।

এরই মধ্যে মিস্টার বিনের সিঁড়িতে আটকে দেওয়া সেই বুড়োর মতো একটা ট্রাক্টর আমাদের সামনে দিয়ে চলছে গজ গতিতে। কতবার বললাম, ভাই একটু জলদি, কিন্তু কে শোনে কার কথা! উল্টো ভরসা দিলো, সামনে একটা চৌমুহনী আছে, ওখানে বাসটা থামবে। ওখানেই বাসটা ধরতে পারবো। নিজের সৌভাগ্যকে গনেশ কর্মকারের পাল্লায় তুলে দিয়ে বসে থাকলাম। কোনোমতে ট্রাকটরটাকে অতিক্রম করে যখন চৌমুহনী পৌঁছলাম, তখনও বাসটা আমার দৃষ্টি সীমানায়। কেবলই চৌমুহনী ছেড়েছে। ভরসা জাগলো পেয়ে যাবো।

দৌড়ে একটা চলন্ত অটোতে উঠে বসলাম। তখনো আকাশে সোনালী আভা। আশেপাশের বাড়িঘর আর টং দোকানে সন্ধ্যা বাতি জ্বালিয়েছে মাত্রই। মনে মনে আফসোস করছিলাম, প্রত্যেক বাসে যদি ৯৯৯ এর মতো একটা করে নম্বর থাকতো! তাহলে ফোন কল করে থামাতে পারতাম। এদিকে গর্তে পড়া অটোর গতির উঠানামার সাথে আমার বাস প্রাপ্তির আশা নিরাশা সমানতালে পাল্লা দিতে লাগলো। একটা সিগারেট জ্বালালাম। কিছুটা স্বস্তি, বাসটা দেখা যাচ্ছে! চরম উত্তেজনায় জ্বলন্ত সিগারেটের ছাঁইয়ের কেবল দৈর্ঘ্যই বাড়লো, টান আর দেওয়া হলো না।

অনেকটা এগোনোর পরে সামনের রাস্তাটা সাপের জিহ্বার মতো দুই ভাগ হয়ে গেলো। বাসও প্রায় হাতের নাগালে। অটো ভাড়া মুঠোয় নিয়ে অপেক্ষায়, টপ করে নামবো আর চট করে উঠে পড়বো বাসে। মাথায় আকাশটা ভাঙলো ঠিক এখানেই। বাস ধরলো ডানের রাস্তা আর অটো যাবে বাঁয়ের রাস্তায়। ড্রাইভার আশ্বাস দিলো, সামনেই বাখরাবাদ গ্যাসফিল্ড বাজার। বাস ওখানে কাউন্টারে দাঁড়াবে। পেছনের অটোটা ধরলেই পেয়ে যাবেন। কথায় আস্থা রেখে নেমে গেলাম।

মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেলো। তবে একটু স্বস্তিও পাচ্ছিলাম ভেবে, বিউটি বউদির দেওয়া দুধের ক্যানটা আনিনি। একটা অটো এলো। লাফিয়ে উঠে পড়লাম, বাস আমি ধরবোই। মোয়াজ্জেন গলা খুললেন মসজিদে। অটো ড্রাইভারকে সমস্ত কাহিনী খুলে বললাম। শুনলো অন্য যাত্রীরাও। ড্রাইভার তার লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে আমার সাথে কথা বলছেন। - চিন্তা কইরেন না স্যার। বাখরাবাদে বাস ধরতে না পারলে আমিই আপনেরে ইলিয়টগঞ্জ নিয়া যামু, রিজার্ভ! ৩০০ টেকা ভাড়া, আপনে আড়াই’শ দিয়েন। - চুপ করো তো ভাই, জলদি টানো।

এতক্ষণে ড্রাইভারের মুখটা ভালো করে দেখলাম। ষণ্ডা মার্কা চেহারা। অটোর ক্ল্যাস টানার সময় দেখলাম, হাতের শিরা-পেশি বেশ মজবুত। রঙিন রূপবান মার্কা হাফ শার্টের উপরে তাবিজ ঝুলানো একটা রূপালী চেইন। একটু পর পর অন্য যাত্রীরাও যার যার মতো করে নেমে গেলো। ড্রাইভার একবার সামনে তাকায়, একবার লুকিং গ্লাসে আমার দিকে। নিজেকে ইচ্ছেমতো খিস্তি দিলাম, কি দরকার ছিল, এত কথা বলে তাকে বুঝিয়ে দেয়ার; আমি যে এই এলাকায় নতুন, পথভ্রষ্ট, কিছুই চিনি না!

কোলের উপর রাখা ল্যাপটপের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে বসলাম। সন্ধ্যা প্রায় বসে গেছে। রাস্তায় চলাচলের অটো আর রিকশাগুলোর হেড লাইট জ্বলছে। হঠাৎ অটোটা থেমে গেলো। যান্ত্রিক গোলযোগ! জায়গাটা নির্জন। আমার মাথায় অন্য চিন্তাগুলো ঢুকছে প্রবল বেগে। অথচ ড্রাইভার ব্যাটার কোনো বিকার নেই! আরামসে নামলো, জংগলের দিকে গেলো, কর্ম সারলো। ফিরে এসে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে এই তার টানে, সেই সুইচে টিপে! পেছনের ইঞ্জিন কাভার খুলে এটা-সেটা নাড়ানাড়ি করলেও অটোর ঘুম ভাঙে না। মোবাইলটা বের করে অটোর নম্বরের ছবি তুলে নিলাম। এবার আমি সবলে বলীয়ান হলাম। বাস ধরার আশা ছেড়ে দিয়ে ভাড়াটা ছুঁড়ে দিলাম তার কোলের উপর। মনে মনে বললাম, ধর ব্যাটা, আমি আমার পথ ধরি।

একটা পঁচিশ-ত্রিশ বছর বয়সের যুবক দর্শক হয়ে এলো। গ্রামেগঞ্জে কিছু হলে চিনির গন্ধে পিপড়ে আসার মতো করে আপনাপানিই দর্শক জুটে যায়। কী হয়েছে, তা জানতে না দিয়েই জিজ্ঞেস করলাম- - ভাই, এখান থেকে বাখরাবাদ কত দূরে? - এই তো, দুই মিনিটের রাস্তা। সামনের টালনিংটা (টার্নিং) পার হইলেই বাখরাবাদ। চলেন আমিও যাইতাছি, বাজারে চা খাইতে। - বাখরাবাদ থেকে ইলিয়টগঞ্জের অটো পামু? - কন কি! এভেলেবেল পাইবেন, রাইত বারোটা পর্যন্ত।

ছেলেটা হাঁটছে, আমিও হাঁটছি। নিজের সাথে নিজে কত কথা বলছি। নিজেকে বকছি, ধমকাচ্ছি ভাগ্যকেও ছাড় দেইনি। এইসময়ে ছেলেটার কানে ফোন, যেন তার বোনের সাথে কথা বলছে- - তোর জামাইয়ে বাইত আইছেনি? আইয়া গ্যাছেও গা? আমরার বাইত আইলো না ক্যারে? হুন, আমি কাইলকা তোরার বাইত যামু। ভাগ্নীর লাইজ্ঞা একটা ঘিয়া কালারের গেঞ্জি কিনছি। কান্ধে ঝুলাইন্যা একটা ব্যাগও কিনছি, গোলাপী কালারের। তারে ইশকুলে দিবি কবে? আমারে কইছ, আমি কেডস কিন্যা দিমু। হ, হ, কিন্ডারগার্টেনেই দিবি। সরকারি পেরাইমারিতে দিছ না। ভাগ্নীরে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ামু।

নিজের দিকে তাকালাম, আরে! আমারো তো ঘিয়ে কালারের গেঞ্জি, কাঁধে ব্যাগ, পায়ে কেডস! তবে কি সাংকেতিক ম্যাসেজ পাশিং এ পড়ে গেলাম! শুনেছি, হাইওয়ে ডাকাত দল এভাবেই সাংকেতিক ভাষায় 'মাল' হাতবদল করে। আমিও কি 'মাল' হয়ে গেলাম! ব্যাটারির রিকশা- প্রথম অটো- দ্বিতীয় অটো- পথ-প্রদর্শক এরা কি সবাই এভাবেই আমাকে হাতবদল করছে! ভয় একটু লাগা শুরু করলো। ভাবতে ভাবতেই বাখরাবাদ স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। ছেলেটাকে মুখে ধন্যবাদ দিলেও 'হাতবদলের' ভয়টা রয়েই গেলো। জমজমাট বাজার। মিষ্টির দোকানে হাই ভলিউমে টিভি চলছে, দর্শকও কম না। হঠাৎ টিভি বন্ধ। না বিদ্যুৎ আছে, মাইকে এশার আযান হচ্ছে। একটা অটো এসে থামল, ইলিয়টগঞ্জ বলতেই ইশারায় বসতে বললো। আমি বললাম, - রিজার্ভ যাবো না, আরও প্যাসেঞ্জার নাও। - যাইতে থাকি, পথে পাইলে লইয়া লমু।

ভয়টা এবার ঝাঁকিয়েই বসলো। বাজার পেরুতেই প্রায় অন্ধকার। যদিও রাখী পূর্ণিমার দ্বিতীয় রাতের চাঁদ আকাশে। চাঁদের মুখে মেঘের আলোয়ান। আলো অনেকটাই স্তিমিত। সাপের শরীরের মতো আঁকাবাঁকা সড়ক। দু'ধারে বিশাল বিল। অনেক দূরে দূরে জলের মধ্যে গলা উঁচিয়ে হিজল-তমাল গাছের মতো একটা দুইটা বাড়ি। সে বাড়িতে জ্বলা লাইট দেখা যায়। অটো ড্রাইভার হাই ভলিউমে ওয়াজ চালিয়ে দিলো! এবারে আমি বুঝে গেছি, কী হতে যাচ্ছে! হাই ভলিউম মানেই যেন কেউ আমার চিৎকার শুনতে না পারে!

একজন হাত দেখালো, অটো থামলো। তার হাতে কাস্তে। আরেক হাতে বাজারের থলে। ড্রাইভারে পাশের সিটেই বসলো। তাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে! কিছু শুনি, কিছু শুনি না! একটু পরে আবার থামলো, এবারে সামনের যাত্রী এসে আমার পাশে বসলো। এরপরে আরও তিনজন। ব্যাগ হাতিয়ে টের পেলাম, জলের বোতলটা আনিনি। খুব তেষ্টা পেয়েছে, জলের দরকার। আমার গা ঘেঁষা লোকটার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম। আমার শুকনো কণ্ঠ, গলা দিয়ে সব শব্দ বেরও হয় না। এক কথা বারবার বলি। কাস্তেটা দেখিয়ে বললাম - ভাই এইডা বগা কাঁচি না? - হ ভাই, ধার দিয়া আনছি। ভোঁতা কাঁচি দিয়া ধান কাটন যায় না, ধান কাটুম।

অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করে মনে। আমি কেন যেন তার 'ধান' শব্দটা শুনি না, শুধু 'কাটুম'ই শুনি! বন্ধু দুলালের কথা মনে পড়লো। অনেক আগে, একবার বলেছিল, - এই রাস্তায় সন্ধ্যার পরে যাবি না। ডাকাতি হয়, খুন করে বিলে ফেলে দেয়। ইলিয়টগঞ্জ বাজারের পরে একটা জায়গা আছে, দুই দিকে বিশাল বিল, বাংলা অনেক ‘দ’ একসঙ্গে জুড়ে দিলে যেমন হয়, তেমন আঁকাবাঁকা রাস্তা। এখানেই ডাকাতরা রাস্তায় গাছ ফেলে ডাকাতি করে!

অটোর ঘুরানো-ফেরানো টের পেলাম। আমি এখন সেই ‘দ’ অঞ্চলেই আছি। সত্যিই, এখানে আমাকে কেটে টুকরা করে ওরা চড়ুইভাতি করলেও কাক-পক্ষী জানবে না। আমি আমার মধ্যে আর নাই, নিজের চোখে নিজের মাংস টুকরাই যেন দেখছিলাম!

কিছুটা কোলাহল-শোরগোল, গাড়ির হর্ন, চোখ ধাঁধানো আলো। নিজের মধ্যে ফিরে এলাম। তাকিয়ে দেখি ‘বিসমিল্লাহ হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ’, ইলিয়টগঞ্জ বাজার, কুমিল্লা।