সাতসতেরো

বাংলাদেশের পরম বন্ধু জর্জ হ্যারিসন

জর্জ হ্যারিসন বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন জনপ্রিয় গায়ক এবং গিটারিস্ট। দুনিয়ায় সাড়া জাগানো ‘দ্য বিটলস’ ব্যান্ড দলের এই লিড গিটারিস্ট মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে তিনি গোটা বিশ্বকে করেছিলেন জাগ্রত। 

বাংলাদেশের এই পরম বন্ধুর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডে ফ্রাইয়ার পার্কে তার বাড়িতে ঢুকে মানসিকভাবে অসুস্থ এক ব্যক্তি জর্জ হ্যারিসন ও তার স্ত্রী অলিভিয়ার ওপর ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। এতে হ্যারিসনের ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে একসময় তার ফুসফুসে ক্যান্সারও ধরা পড়ে। অবশেষে ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে মারা যান এই কিংবদন্তি।

জর্জ হ্যারিসন সংগীতের আকাশে সবসময়ই নিজের দীপ্তি ছড়িয়েছেন। আপন মহিমায় হয়েছেন ভাস্বর। সংগীতশিল্পীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন গীতিকার, সংগীত ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের কথা বিশ্ববাসীকে জানাতে কনসার্টের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গান গেয়ে শোনান। কনসার্টের নাম ছিল- কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। 

তার নেওয়া এই উদ্যোগ নাড়া দিয়েছিল পৃথিবীর মানুষকে। সবাইকে জানিয়েছিলেন পাক হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের ওপর কী নিপীড়ন আর হত্যাযজ্ঞই না চালাচ্ছে। তুলে ধরেছিলেন প্রতিবেশী ভারতে শরণার্থী হওয়া কোটি মানুষের দুঃসহ বেদনার কথা। 

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট উপমহাদেশের কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশংকের অনুরোধে কনসার্টটির আয়োজন করেন এই ব্রিটিশ সংগীশিল্পী। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ঐতিহাসিক মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে। কনসার্ট থেকে পাওয়া অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে খরচ হয়েছিল বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য।

কনসার্টটিতে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন নোবেল বিজয়ী বব ডিলানসহ পৃথিবী সেরা শিল্পীরা। কেবল তাই নয়, সেদিনের কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের লেখা, সুর করা ও গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। গানের শুরুটা ছিল ‘আমার বন্ধু এসেছিল-’। এই বন্ধু বলতে তিনি রবি শংকরকে বুঝিয়েছেন। পরে গানের প্রতিটি লাইনে তিনি অসাধারণ কথামালায় তুলে ধরেছেন নিপীড়িত মানুষের কথা। ছিল বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গভীর এক আবেদন।

জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস এর ‘দ্য রেকর্ড প্লাট’ নামের বিখ্যাত স্টুডিওতে ধারণ করা হয়েছিল। ওই মাসেরই ২৮ তারিখ অর্থ্যাৎ ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর ঠিক তিন দিন আগে গানটি রিলিজ করা হয়। জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে এই গানটির সহ প্রযোজক ছিলেন আমেরিকান বিখ্যাত প্রযোজক, সংগীতশিল্পী ও গীতিকার হার্ভি ফিলিপ স্পেক্টর। যিনি মূলত ফিল স্পেক্টর নামে পরিচিত ছিলেন। আমেরিকান সংগীতশিল্পী লিয়ন রাসেল, সেক্সোফোন বাদক জিম হর্ন এবং ড্রামার জেমস লি কাল্টনার গানটি ধারণে সহায়তা করেন। আরো সহায়তা করেন ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী ও এক সময়ের দ্য বিটলস ব্যান্ডের ড্রামার রিঙ্গো স্টার।

পৃথিবীর ইতিহাসে ‘বাংলাদেশ’ গানটিই ছিল প্রথম কোন চ্যারিটি সংগীত। গানটিকে বলা হয় ‘সংগীতের ইতিহাসের অন্যতম নিবিড় সামাজিক বক্তব্য’। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ‘বাংলাদেশ’ গানটি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘গানটির মধ্যে যে হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য উঠে এসেছে, তা বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে স্পর্শ করেছে।’

বাংলাদেশের মহান বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের লিভারপুলে।