সাতসতেরো

শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান রোকেয়া 

পঞ্চগড়ের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম (৬৭)। ১৯৭১ সালে সদ্য এসএসসি পাস করা ছাত্রী ছিলেন তিনি। রেডিওতে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে সিদ্ধান্ত নেন মাতৃভূমিকে মুক্ত করবেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে অংশ নেন স্বাধীনতা যুদ্ধে।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার মুনিগছ গ্রামের মৃত আব্দুর রহিমের মেয়ে রোকেয়া বেগম। বর্তমানে তিনি জেলা শহরের মিলগেট এলাকার বাসিন্দা। আব্দুর রহিম ছিলেন দর্জি। মা ছমিরন নেছা গৃহিণী। পরিবারে তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে রোকেয়া তৃতীয়। 

যুদ্ধকালীন দিনের স্মৃতিচারণ করে রোকেয়া বলেন, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তখন আমরা খবর শুনতাম রেডিওতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাকে উদ্বেলিত করে। যুদ্ধ শুরু হলে আমার মেজ ভাই নাসিদুলসহ গ্রামের অনেকে যুদ্ধে যোগ দেয়। এরপর ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ খবর আসে ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। 

ছেলে হারানোর শোকে তখন আমার মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিন্তু বাবার মনোবল ছিল দৃঢ়। বাবা আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল বড় ভাই আব্বাস আলীর সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। তখন আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাধার মুখে পড়েছিলাম। অনেকে কটূক্তিও করেছেন। মেয়ে মানুষের যুদ্ধে কাজ কী- এসব কথা বলতেন অনেকে। কিন্তু আমি পিছপা হইনি। 

প্রথমে ভারতের ভুষপিটা ক্যাম্পের শরণার্থী শিবিরে যাই। সেখানে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের পাঠদান করাই ছিল কাজ। যেহেতু আমি পড়ালেখা জানতাম আমার সমস্যা হয়নি। হঠাৎ শিবিরে ডায়রিয়া, খোসপাঁচড়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন চিকিৎসকদের কাছে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেই। এরমধ্যে খবর পেলাম তেঁতুলিয়ায় অস্থায়ী ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে সেবিকা নিয়োগ দেয়া হবে। আমি তখন সেখানে যুক্ত হতে চাই। বয়স কম হওয়ার কারণে প্রথমে বাদ পড়ি। পরে অনেক অনুরোধ করে সেবিকাদের দলে যুক্ত হই। সেখানে ডা. আতিয়ার রহমানের অধীনে যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ, আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছি আমি। 

একদিন মুক্তিযোদ্ধারা ৭-৮ বছর বয়সি এক শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। মাইন বিস্ফোরণে দুই পা বিচ্ছিন্ন ছিল শিশুটির। শিশুটি সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল- আমি বাঁচতে চাই। এদিকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। শিশুর সেই আকুতি ‘আমি বাঁচতে চাই’ এখনও কানে বাজে। 

রোকেয়া বলেন, শুধু চিকিৎসাসেবা দেইনি। রান্নার কাজও করেছি। অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে যেতে পারিনি। কিন্তু জীবন বাজি রেখে সবসময় মুক্তিবাহিনীর পাশে ছিলাম। 

রোকেয়া বেগম দীর্ঘদিন পঞ্চগড় সুগার মিলে চাকরি করেছেন। বর্তমানে চাকরি থেকে অবসরে গেলেও অবসর ভাতা পাননি। তবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়েই চলছে জীবন। তিনি সময় পেলেই নিজ খরচে জাতীয় পতাকা ও ব্যাজ তৈরি করেন। সেগুলো শিক্ষার্থীদের বিতরণ করেন। এবারও বিজয়ের মাসে তিনি জেলার স্কুলগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিচ্ছেন, শোনাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প।