সাতসতেরো

রেডিও-টেলিভিশন কেন্দ্রের নতুন নামকরণ

উত্তাল একাত্তরে অগ্নিঝরা মার্চের ৪ তারিখ ছিল দেশব্যাপী লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ২ ও ৩ মার্চ সর্বাত্মক যে হরতাল পালিত হয়, সারা দেশজুড়ে ছিলো তারই রেশ। তবে এই দিনের হরতাল ছিলো আট ঘন্টার। 

এদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের নতুন নামকরণ করেন ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র।’ পাকিস্তান টেলিভিশনের নাম পাল্টে ‘ঢাকা টেলিভিশন‘ নাম দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতে থাকে। 

এসময় আন্দোলনকামী তারুণ্যের রক্ত যেন টগবগ ফুটছে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন, কী বলবেন নেতা-চারদিকে তারই উত্তেজনা। বাংলাদেশ তখন বিদ্রোহ-বিক্ষোভে টালমাটাল। 

অন্যদিকে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশিয় দোসর রাজাকার-আলবদররাও বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলন নস্যাতে তৎপর। কার্ফ্যু দিয়েও সামরিক জান্তারা বীর বাঙালীদের ঘরে আটকে রাখতে না পেরে গোপনে বাঙালী নিধনের পরিকল্পনা আঁটতে থাকে। তবে তারাও অপেক্ষা করতে থাকেন- ৭ মার্চের ভাষণে কী বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

৭ মার্চের জনসভা সফল করার জন্য আন্দোলনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের দফায় দফায় বৈঠক চলতে থাকে। পাশাপাশি ঢাকাসহ সারাদেশেই গঠন হতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র নেতারা গোপনে নানা স্থান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান চালাতে থাকেন বেশ জোরেশোরেই।

বঙ্গবন্ধু ঘোষণা অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক সফল হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় সাময়িকভাবে কার্ফ্যু তুলে নেওয়া হলেও চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুরে তা বলবৎ থাকে। খুলনায় হরতাল পালনকালে নিরস্ত্র জনতার ওপর সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণে ৬ জন নিহত হয় ও ২২ জন আহত হয়। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে গতকাল আর আজ মিলে সর্বমোট ১২০ জন নিহত ও ৩৩৫ জন আহত হয়। 

সারাদেশে আহতদের সুচিকিৎসার্থে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত সহস্র মানুষ লাইন দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। 

এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক মূলতবী সভায় ভবিষ্যত কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে সংগ্রামের নতুন দিকনির্দেশনায় বলেন, ‘আজ আওয়ামী লীগ নয় গোটা বাঙালী জাতিই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন। আমাদের সামনে আজ দুটো পথ খোলা আছে। একটি সর্বাত্মক ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের মনোবল অটুট রেখে অবিচলভাবে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া অথবা ভুট্টো ইয়াহিয়ার কথামতো সবকিছু মেনে নেওয়া।’

বঙ্গবন্ধু নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমি সারা জীবন ক্ষমতার মসনদ তুচ্ছজ্ঞান করে দেশ ও জাতির কাছে আমার জীবন মর্টগেজ রেখেছি। বাংলার মানুষ গুলি খেয়ে বন্দুকের নলের কাছে বুক পেতে দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে আমাকে মুক্ত করে এনেছে। আমার ৬ দফা কর্মসূচীর প্রতি ম্যান্ডেট দিয়েছে। এখন শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি অশ্রদ্ধা জানিয়ে পাকিস্তানীদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে অবমাননাকর শর্তে কী করে ক্ষমতায় যাই।’