সাতসতেরো

‘অবাঙালি মুসলমানরা এসে সব দখল করে নেয়’

একাত্তরের ২৫শে মার্চ, বৃহস্পতিবার। পুরান ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয়, ঘুমন্ত সাধারণ মানুষের ওপর যে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার নজির। ২০১৭ সাল থেকে দিনটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। সেই ভয়াল রাতের প্রত্যক্ষদর্শী পুরনো ঢাকার রাজার দেউড়ী নিবাসী বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরু। সেদিনের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতার বয়ান তিনি তুলে ধরেছেন এই লেখায়। 

সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। আমি তখন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। ২৫শে মার্চ বিকেল থেকেই পুরান ঢাকার কোর্ট-কাচারি ও শাঁখারী বাজার এলাকায় বেশ থমথমে ভাব। সবার মনে আশঙ্কা আজ কিছু একটা হতে চলেছে! সে ভয় থেকেই বড়দের পরামর্শে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট আসার প্রধান সড়ক নবাবপুর রোড ও শাঁখারী বাজার রোড়ে ছাত্র ও যুবকরা কাঠ, ইট, বাঁশ ও ঠেলাগাড়িসহ নানাভাবে ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সে অনুযায়ী রায় সাহেব বাজার মোড়, শাঁখারী বাজার মোড় ও বাংলাবাজার মোড়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল। 

সেদিন রাতে আমরা খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ঠিক কয়টা বাজে মনে নেই; এমন সময় আমার বড় ভাই ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। দৌড়ে বাসার ছাদে এসে দেখলাম শাঁখারী বাজার ও সদরঘাট এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আকাশে এক ধরনের আলো ছুড়ে দিচ্ছে। ফলে সেই জায়গাটি দিনের মতো আলোকিত হচ্ছে। পরে সেখানে নির্বিচারে ছোড়া হচ্ছে গুলি। আমরা বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কি ঘটছে! তবে প্রচুর মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে সেটি টের পাওয়া যাচ্ছিল। 

এমন করে রাতটা কোনো রকম কাটলো। পরদিন শুক্রবার আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখলাম আমাদের বাড়ির বিপরীতে একটি পাগল পাটের বস্তা গায়ে শুয়ে থাকতো। নিরীহ তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শাঁখারী বাজার সেসময়ও বেশ ঘিঞ্জি ছিল। তাই সেখানে বেশি বাড়িতে তারা প্রবেশ করেনি। তবে প্রথমদিকে বাড়িগুলোতে ঢুকে যাকে পেয়েছে হত্যা করে চলে গেছে। সদরঘাটের বর্তমান প্রধান যে টার্মিনাল, সেটি তখনও সেখানেই ছিল। সেখানে অনেক ভাসমান মানুষ রিকশা বা ঠেলাগাড়িতে রাতে ঘুমাতেন; তাদেরও হত্যা করা হয়েছে। এখন বিভিন্ন ছবিতে ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, রিকশায় যে লাশগুলো আমরা দেখি তা মূলত শাঁখারী বাজার মোড় ও সদরঘাট এলাকার ছবি।  এসব দেখতে দেখতে চলে গেলাম বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দিকে। বর্তমান ফাঁড়ি সেখানেই আছে। দেখলাম সেখানে ৩-৪ জন পুলিশ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর দেখলাম মানুষ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নলগলা ঘাট বা ওয়াইজ ঘাট হয়ে নদীর ওপারে যাওয়ার জন্য উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাচ্ছে। সবার চোখে-মুখে আতঙ্কের স্পষ্ট ছাপ। হৃদয়ে বাঁচার আকুতি। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই ছুটছে নদীর ওপারে। সেসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ কেউ চলে গেছেন ভারতে। 

আমরা বাসায় ফিরে এলাম। এসে দেখি আমাদের বাড়ির বিপরীত পাশে স্কুটি রাখার গ্যারেজ ও একটি প্রেস ছিল, সেখানে ঢুকে কর্মচারীদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেখানেই শেষ নয়, এরপর আগুন লাগিয়ে দিয়েছে পাকবর্বরেরা। আমরা যারা আশপাশের বাসিন্দা ছিলাম যে যেভাবে পারি আগুন নেভানোর চেষ্টা করলাম। তবে আগুন সম্পূর্ণরূপে নেভাতে পারিনি। আমরা চেষ্টা করছিলাম যাতে আগুন ছড়িয়ে অন্য বাড়িতে না যায়। সেই আগুন টানা তিন দিন জ্বলেছে। ইতোমধ্যে পুরান ঢাকায় যেসব হিন্দু পরিবার থাকতেন তাদের বাসাগুলো খালি হয়ে গেলো। কিছু কিছু মুসলিম পরিবারের বাসাও খালি হয়ে গেলো। সেসময় মোহাম্মদপুর, মিরপুর থেকে অবাঙালি মুসলিম যাকে আমরা ‘বিহারী’ বলছি তারা এসে দখল করে নিলো সব। অথচ ৭১-এর আগে সেখানে কোনো বিহারী ছিল না। সেসময় আমাদের মহল্লার অনেক বাড়ির দরজায় বা মূল ফটকে আরবি হরফে আল্লাহু, আল্লাহু আকবার কিংবা কালেমা লেখা থাকতো। যেসব হিন্দু পরিবার রয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়ির দরজাতেও এমন লেখা দেখা যেত। এটা এজন্য করা হয়েছিল যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা থেকে, নিশ্চিত মৃত্যু থেকে তারা রক্ষা পান। 

বাবা আমাদের পাঁচ ভাইকে ডেকে বললেন, তোমরাও নদী পার হয়ে যাও। পরদিন ২৭ মার্চ আমরা নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জে একটি স্কুলে আশ্রয় নেই। সেখানে গিয়ে দেখলাম আমাদের মতো অনেক যুবক আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে থাকতেই আমরা শুনলাম ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। স্কুলে এক রাত কাটিয়ে আমরা বিক্রমপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ঘাটে গিয়ে দেখি কিছু লঞ্চে তৎকালীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ছে। আমাদের বিনা ভাড়ায় তারা আলমগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত নিয়ে গেলো। এরপর দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকলো। ভাইদের সঙ্গে আমিও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলাম। 

অনুলিখন: জাহিদ সাদেক