বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখ। এ মাসের প্রথম দিনে নববর্ষের উদযাপন করা আমাদের বাঙালিয়ানার রীতি। এটি আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশও বলা চলে। এই উৎসব ইতিহাস-ঐহিত্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। এদিনে বিভিন্ন রকমের খাবারের পাশাপাশি হরেক কিসিমের পোশাক পরে উৎসবে মেতে উঠা চলে আসছে দীর্ঘকাল থেকে।
বাংলাদেশের মানুষের পাশাপাশি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার বাঙালিরা নববর্ষের দিনটিকে বিশেষ উৎসব হিসেবে উদযাপন করে আসছে। এদিনে সবাই নিজের এবং আত্মীয়-পরিজন সকলের সুখ-সমৃদ্ধি ও মঙ্গল কামনা করে। ব্যবসায়ীরা পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন বছরে যাত্রা শুরু করে। যাকে বলে হালখাতা। ক্রেতাদের মিষ্টি মুখ ও উপহার দিয়ে অতীতের হিসাবের খাতার ইতি টানা হয় পহেলা বৈশাখে, নতুন বছরের প্রথম দিনে।
কে, কবে, পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে অকপটে মিলিয়ে ফেলেছে পান্তা-ইলিশের আহারবিলাস। নতুন বছরের প্রভাতে ইলিশ ভাজা, মরিচ পোড়া, বেগুন ভাজা, আলুভর্তা আর পান্তা ইলিশের ভোজ না হলে যেন বৈশাখের উদযাপনই ঠিকঠাক হয় না।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, পহেলা বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের প্রচলনের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। এই পান্তা-ইলিশের সূচনা হয় ১৯৮৩ সালে রমনার বটমূলে। এদিন রমনার বর্ষবরণ উৎসব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার সুবাদে ব্যাপক লোক সমাগম হয়। সে অনুষ্ঠানে কী করে যেন মিঠাই, মণ্ডা, খই, জিলাপি, বাতাসা এসবের পাশাপাশি বাঙালিদের রসনায় জায়গা করে নেয় পান্তা-ইলিশ।
আবহমানকাল থেকেই পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন হিসেবে বাঙালি উদযাপন করে আসছে মেলা, হালখাতাসহ নানাভাবে। এদিন ঘরে ঘরে ভালো খাবারের আয়োজনও নিয়মিত চলে আসছে। তবে পান্তা কিংবা ইলিশ কখনোই পহেলা বৈশাখের খাদ্য তালিকায় ছিল না। এর প্রচলন ১৯৮৩ থেকে।
খুব দ্রুত হুজুগে বাঙালির পহেলা বৈশাখের মূল খাবারের মধ্যে জায়গা করে নেয় পান্তা-ইলিশ। পহেলা বৈশাখের সমার্থক হয়ে উঠে পান্তা ভাত আর ইলিশ ভাজা। যেনো ‘দুজনে দুজনার’।
অথচ প্রকৃতি বলছে ভিন্ন কথা। বৈশাখ অর্থাৎ এপ্রিল মাস জাটকা ইলিশের নদী থেকে সাগরে ফিরে যাওয়ার সময়। তাই জাটকা নিধন রোধে এসময় সরকারিভাবে ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ থাকে। তাই পহেলা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার ব্যাপারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মৎস্যবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু তারপরও প্রকৃত অবস্থাটা একেবারে ভিন্ন।
নারীদের লাল-সাদা শাড়ি বা সালোয়োর কামিজ, পুরুষের লাল-সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে শিশুদের নানান রঙের পোশাকের পাশাপাশি বাঙালির জীবনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে চলতে থাকে পান্তা-ইলিশ। এসময় ইলিশ ধরা ও বিক্রয়- দুটোই নিষিদ্ধ থাকে। সেটি কিন্তু কাগজে কলমে। বরং এসময়কে ঘিরে ইলিশ বেশি দামে বিক্রি হয় বাজারে।
মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) নিউ মার্কেট ও হাতিরপুল মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৮০০ গ্রাম থেকে এক কেজি পর্যন্ত ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কেজি ১০০০ টাকায়। আর এককেজি ২০০ গ্রাম থেকে তদূর্ধ্ব ইলিশের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকায়। সেখানেও হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন অনেক ক্রেতা। যত দ্রুত সম্ভব ইলিশ কিনে বাড়ি নিতে পারলেই যেনো ‘কিছু্ একটা’ জয় করা হয়ে যাবে- এমনটাই ভাবনা।
পহেলা বৈশাখের দিনে ইলিশ না খাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ইদানীং গণমাধ্যমেও মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এসময় মা ইলিশের ডিম পাড়ার সময়। তাই কোনোভাবেই ইলিশ ধরা, বিক্রয় বা না খাওয়ার জন্য।
কবি আসাদ চৌধুরী সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নতুন বছরের প্রথম দিন পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়া কোনোভাবে বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়। এসময় ইলিশ মা ডিম পাড়ে। তাই ইলিশ না খেয়ে এসময় অন্য যে কোনো মাছ, মাংশ, বিরিয়ানি, ফল, মিষ্টান্ন খাবেন। সবাইকে এদিনে ইলিশ না খাওয়ার আহ্বান জানাই।
আসুন, সবাই মিলে পহেলা বৈশাখের দিন ইলিশকে ‘না’ বলি। নতুন বছর সবার জীবনে মঙ্গল আর কল্যাণ বয়ে আনুক। শুভ নববর্ষ ১৪২৯।