সাতসতেরো

খবর বিক্রেতার খবর কেউ রাখে না

ভোরের আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন শুরু হয় তাদের। কাকডাকা ভোর থেকে পত্রিকা নিয়ে তাকে ছুটতে হয় গ্রাহকের দুয়ারে। ঝড়-বৃষ্টি, গরম কিংবা শীত এ নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটে না। তারা মানুষের অধিকার আদায়ের সংবাদ পৌঁছে দিলেও নিজেদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশ-বিদেশের খবর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলেও তারা রয়ে যান খবরের অন্তরালে।

রাজধানীতে বেশ কয়েকজন পত্রিকার হাকারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা। পুরানা পল্টন যাত্রী ছাউনীর পত্রিকার হকার রাকিব অথবা দৈনিক বাংলা মোড়ের মুসলিম উদ্দিন, সবারই কথা প্রায় এক। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী প্রতিদিন পাত্রিকা বিক্রি করে ২৫০-৩০০ টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে একজন মানুষেরই চলা মুশকিল, পরিবার থাকলে কঠিন বিপদ। অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই। পত্রিকা থেকে কেনো খোঁজখবর রাখে কিনা জানতে চাইলে মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছর রমজানের ঈদের আগে বছরে একদিন সব পত্রিকা ফ্রি পাই। বছরে এই একবারই। তাছাড়া আজকাল কেউ কারো খবর রাখে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত।’ ক্ষোভ ঝরে পড়ে মধ্যবয়সী এই হকারের কণ্ঠে। 

নারিন্দা মোড়ে মাটিতে পলিথিন পিছিয়ে পত্রিকা বিক্রি করেন বৃদ্ধ গফুর মিয়া। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে পত্রিকা বিক্রি করছেন তিনি। সকালে বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করেন, বাকি সময় মোড়ে পত্রিকা বিক্রি করে যে টাকা পান তা দিয়ে সংসার চলে না বলে জানান তিনি। বয়স হওয়ায় আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না জানিয়ে গফুর মিয়া বলেন, ‘সব জিনিসের দাম বাড়ে কিন্তু আমাদের কমিশন বাড়ে না।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকাশকের কাছ থেকে হকার্স সমিতি পত্রিকা পায় ৩৫ শতাংশ কমিশনে। এর থেকে হকাররা পত্রিকা পান ৩২ শতাংশ কমিশনে। মাঠ পর্যায়ের হকাররা অনেক পত্রিকার ক্ষেত্রেই নির্ধারিত কমিশন পান না। মধ্যস্বত্বভোগীরা তাতে ভাগ বসায়। ১৯৭৪ সাল থেকে একই রেটে চলছে পত্রিকা বিপণন। অনেক সময় গড়িয়েছে। দুই টাকার পত্রিকা ১২ টাকা হয়েছে, সবার লাভ বেড়েছে। কিন্তু হকারদের আয় বাড়েনি। অনেকে পত্রিকার সংখ্যার কথা বলেন, কিন্তু হকাররা বলছেন, তাতে কাজ হচ্ছে না। 

এজন্য অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। লক্ষ্মীবাজারে পত্রিকা বিক্রি করেন সাইদ। তিনি বলেন, আমরা আগে তিন ভাই এ কাজে যুক্ত থাকলেও এখন শুধু আমিই আছে। বাকি দুজনের একজন চাকরি করে, অন্যজন অটোরিকশা চালায়। এর মধ্যে রয়েছে ফুটপাথে হয়রানি। ফুটপাথের অস্থায়ী দোকান ভেঙে দেওয়ায় অনেক জায়গায় ভাসমান পত্রিকার স্টলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। পুনর্বাসন না করে প্রতিদিনই চলছে উচ্ছেদ অভিযান। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন পত্রিকার হকাররা। তাদের দাবি, যত দিন পুনর্বাসন না করা হচ্ছে, অন্তত তত দিন সংবাদপত্র বিক্রেতাদের আগের জায়গায় বসতে দেওয়া দরকার। 

‘গরিবদের দুই মেয়র পছন্দ করেন না’- এমন হতাশার কথা বললেন গুলিস্তানের পত্রিকার হকার বাবুল। হকারদের সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে পত্রিকার মালিকেরা আমাদের খোঁজখবর রাখতেন, এখন আর রাখেন না। 

কথাপ্রসঙ্গে জানা গেল, হকারদের এই সমিতি ১৯৬৬ সাল থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এসে অবশেষে ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বর্তমানে প্রায় ১৭ হাজার হকার এবং ৭০০ স্টাফ নিরন্তর কাজ করছেন এই সমিতির অধীনে। এই সমিতির আওতায় রাজধানী ঢাকাসহ গাজীপুর, কাপাসিয়া, মুন্সিগঞ্জ, মাওয়া, সাভার, জিরানী, বাইপেল, নারায়গঞ্জ-এ পত্রিকা যায়। সমিতি থেকে একজন হকার কী সুবিধা পান জানতে চাইলে আব্দুল মান্নান বলেন, কোনো হকার মারা গেলে আমরা তার পরিবারকে নগদ ২৫ হাজার টাকা দেই। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার সিংহভাগই আমরা দিয়ে থাকি। এ ছাড়া কেউ নাবালক ছেলেমেয়ে রেখে গেলে আমরা তার লেখাপড়ার খরচ বহন করি। 

হকারদের বর্তমান সমস্যা নিয়ে সমিতির এই নেতা বলেন, ‘এখন হকাররা পত্রিকা বিক্রি করার মতো কোনো জায়গা পান না। ১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ঢাকায় পত্রিকা বিক্রির জন্য কিছু জায়গায় ছাউনী নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেগুলো ফুটপাথ দখলের অভিযোগে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। জায়গা হারিয়ে অনেকে সর্বশান্ত হয়েছেন। ফুটপাথ থেকে পত্রিকার হকারদের উচ্ছেদের পর মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন ভাসমান পত্রিকা স্টলের বিক্রেতারা। 

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আব্দুল মান্নান। তার অভিযোগ পত্রিকার মালিকেরা এখন পত্রিকা প্রিন্ট করেই খালাস কিন্তু পাঠক বৃদ্ধি করার উদ্যোগ তারা নেন না। যে কারণে বিক্রির পরিমাণও দিনে দিনে কমছে। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিন বলেন, সংবাদপত্রের হকারদের জন্য যদি সিটি করপোরেশন কোনো ব্যবস্থা করে, তাহলে অন্য হকাররা আমাদের ওপর আরো চাপ দেবে। সুতরাং এখন কাউকে সুযোগ দেওয়া যাবে না। 

পুনর্বাসনের জন্য ২ হাজার ৫০২ জন হকারের তালিকা করেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলেও জানান মো. রাসেল। এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসও প্রকৃত হকারদের তালিকা তৈরি করে তাদের পুনর্বাসন করার আশ্বাস দেন।