সাতসতেরো

হিমালয়ের দুর্গম একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ১৭০০ কিলোমিটার হাঁটবেন শাকিল

জীবন বিশ্রামাগার নয়। জীবন মানেই নিরন্তর ছুটে চলা, প্রতিনিয়ত নিজেকে অমর করার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়া। শাকিলের চেয়ে এ কথা আর কেউ বেশি অনুভব করেন না। এক জীবনে হাতে গোনা দু’একজন তরুণ অদম্যপ্রাণ দুঃসাহসিক অভিযানের শপথ নেন। তাদের কেউ হয়তো স্পর্শ করতে চান হিমালয়ের চূড়া কিংবা নেমে যেতে চান সমুদ্রের অতল গহীনে। শাকিলের স্বপ্ন একটু ভিন্ন। তিনি হিমালয়ের উপরিভাগ ধরে ১৭০০ কিলোমিটার হেঁটে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার সংকল্প এঁটেছেন। এই ‘গ্রেট হিমালয় ট্রেইল’ অভিযান বাংলাদেশের কেউ করেনি আগে। আজ সেই দুঃসাহসিক অভিযানের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়েছেন ইকরামুল হাসান শাকিল।

হিমালয় পর্বতের পশ্চিমে নেপাল তিব্বতের সীমান্ত এলাকা হিলশা থেকে শুরু করে পূর্বের কাঞ্চনজঙ্ঘা বেইজক্যাম্প পর্যন্ত টানা ১৭০০ কিলোমিটার পথকে বলা হয় 'গ্রেট হিমালয় ট্রেইল'। এই ট্রেইল পাড়ি দিতে যাচ্ছেন দেশের তরুণ এই পর্বতারোহী। 

গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ফুলবাড়িয়ায় জন্ম শাকিলের। গাজীপুরের জনতা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন উত্তরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। বাবা মো. খবির উদ্দিনের তিন ছেলের মধ্যে বড় শাকিল। ২০১৯ সালে বাবাকে হারানোর পর নানা চড়াই-উৎরাই পার করেছেন তিনি। সংসার সামলাতে নানা ধরনের কাজ করেছেন এই তরুণ। এমনকি সুপারশপে বিক্রয়কর্মী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।

ছোটবেলা থেকেই দুঃসাহসিক এবং অন্যরকম স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন শাকিল। গ্রামে বেড়ে ওঠায় সাধারণ ৮-১০ জন শিশুর মতোই কেটেছে বাল্যকাল। ছোটবেলা গ্রামে সাপ খেলা দেখে শাকিল সাপুড়ে হতে চেয়েছিলেন। একবার কাঠমিস্ত্রীর হাতের অবাক কারুকাজ তাকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিল যে, এবার আর সাপুড়ে নয়, কাঠমিস্ত্রী হবেন ভেবেছিলেন। তবে যাই হোক না কেন, শাকিলের বাল্যভাবনায় খেলাধুলার স্থান থাকতো সবার উপরে। ফলে এক সময় সব বাদ দিয়ে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন জাগে তার মনে। আর এসব স্বপ্ন দেখতে দেখতেই কখন যে শাকিলের মনে পর্বতারোহী হওয়ার স্বপ্ন গেড়ে বসলো বলা কঠিন। 

শাকিলের পর্বতারোহী হওয়ার স্বপ্নের যাত্রা শুরু মূলত ২০১০ সাল থেকে। ২০১১ সালে শাকিল যোগ দেন ‘পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশে’। দলের সঙ্গে ভারত যাওয়ার সুযোগ পান শাকিল। এরপর মাথায় ভাবনা আসে অন্যরকম কিছু করার। সেই ভাবনা থেকেই পায়ে হেঁটে কলকাতা থেকে ঢাকা ফেরেন তিনি। সেই ২০১৩ সালে কলকাতা থেকে হেঁটে ১১ দিনে ঢাকা পৌঁছান এই তরুণতুর্কী। 

সেবছরই বলা যায় বুকে সাহস এসে ভর করে শাকিলের। ‘বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব’ এ যোগ দেন তিনি। ভারত থেকে নেন পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ। এরপর প্রথমবারের মতো ২০১৫ সালে ২০ হাজার ২৯৫ ফুট উচ্চতার ‘কেয়াজো-রি পর্বতশৃঙ্গ’ জয় করতে যাত্রা শুরু করেন শাকিলসহ সাতজন। তবে শেষ পর্যন্ত শাকিলসহ চারজন সেই পর্বতশৃঙ্গ জয় করতে পেরেছিলেন। এরপর ২০১৭ সালে ‘লারকে পিক’ অভিযানে গিয়ে প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য ব্যর্থ হন তিনি। 

এবার সিদ্ধান্ত নেন ভারতের নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেইনিয়ারিং থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেবেন। সেই প্রশিক্ষণের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে তাকে থাকতে হয় বেশ কিছুদিন। এ সময় শাকিল জয় করেন ‘দ্রৌপদী-কা-ডান্ডা-২’ শৃঙ্গ। এরপর ২০১৯ সালে 'হিমলুং' জয়ের স্বপ্নে অভিযানে নামেন তিনিসহ বিভিন্ন দেশের ৮ জন পর্বতারোহী। সেই এবারও কৃতকার্য হন। বাংলাদেশের একমাত্র পর্বতারোহী হিসেবে হিমলুং জয় করেন তিনি। স্মরণে রাখা উচিত সেই দুঃসাহসিক অভিযানে প্রাণ হারায় স্পেনের এক পর্বতারোহী।

'গ্রেট হিমালয় ট্রেইলের' জন্য নেপাল সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারিত ফি দিয়ে অনুমতি নিয়েছেন শাকিল। ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বের রাতে কথা হয় তার সঙ্গে। নিজেই জানালেন, এই অভিযানে সব সময় সঙ্গে থাকবে ক্যামেরা ও জিপিএস ট্রেকিং। তবে যাত্রাপথে থাকবে না কোনো সহযোগী। খাবারের জন্য সঙ্গে নেবেন শুকনো খাবার, সেই অভিযানের গল্পও শাকিল লিখবেন বই আকারে। নিজের স্বপ্ন ও পরিশ্রম নিয়ে শাকিল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম কিছু করার ভাবনা ছিল।  সবসময় নিজেকে নিজে চ্যালেঞ্জ দিতে ভালোবাসি, সেই চ্যালেঞ্জ জয় করতেই বেশি আনন্দ। পর্বতারোহণে আমার কোনো সঙ্গী নেই, কোনো প্রতিযোগী নেই, আমার প্রতিযোগী একমাত্র আমি।

শাকিল যেন কবি কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার মুক্ত জীবনানন্দ। ছোটবেলা থেকেই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় শাকিল পার করতে চান সব বাধা। পর্বতারোহণ করতে যত বাধা আসুক নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে ভালোবাসেন তিনি। বিদ্রোহী কবিতার ভাষায়: ‘আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।’

তরুণ এই পর্বতারোহী শুধু পাহাড় জয় করেন না। নিজের সেসব রোমাঞ্চকর গল্প মলাটবদ্ধ করেছেন। ‘হিমলুং শিখরে’, ‘মাউন্ট কেয়াজো-রি শিখরে বাংলাদেশ’, ‘পর্বতাভিযানে শ্বাসরুদ্ধকর পনেরো ঘণ্টা’ ও ‘পদচিহ্ন এঁকে যাই’ শিরোনামে কয়েকটি বই। তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ 'দেবী' ও ‘হেয়ালী ফেরা'। ‘নুরু মিয়ার কিচ্ছা’ নামে একটি নাটকও লিখেছেন তিনি। বিভিন্ন নাটকের সহকারী পরিচালক ও টিভি অনুষ্ঠানে কাজ করছেন। পরিচালনা করেছেন স্বল্পদৈর্ঘ্য পাঁচটি চলচ্চিত্র।