সাতসতেরো

দুর্যোগগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইবাদত

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হলে তার পাশে দাঁড়ানো, বিপদ মুক্তির জন্য সাহায্য করা ইসলামের শিক্ষা। তাদের দুর্দিনে আর্থিক সহায়তা, খাবার-দাবার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসা ঈমানের দাবি। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো অসহায়-দুর্গত মানুষদের সাহায্য করাও ইবাদত।

আল্লাহ তায়ালা পুরো মুমিনজাতিকে একটি দেহের মতো বানিয়েছেন। দেহের কোনো অংশ আক্রান্ত হওয়া মানে পুরো দেহ আক্রান্ত হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুমিনদের উদাহরণ তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানবদেহের মতো; যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তখন তার পুরো দেহ ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা।’ (মুসলিম : হাদিস ৬৪৮০)

এজন্য যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের প্রতি অসহায়-দুর্গত মানুষদের সাহায্য করতে পবিত্র কুরআনে নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সেদিন আসার পূর্বেই যেদিন কোনো বেচাকেনা, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৫৪)।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দয়াশীলদের ওপর করুণাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদেরকে দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ : হাদিস ৪৯৪১)

তবে এই ব্যয়, দান ও দয়া হতে হবে নিঃস্বার্থভাবে, অভাবী ও বিপন্ন মানুষের কাছ থেকে কোনোরকম প্রতিদানের আশা ছাড়া, কেবল আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। যেমন আল্লাহ তায়ালা সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত এতিম ও বন্দিদের খাবার দান করে। তারা বলে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবার দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা দাহর : আয়াত ৮-৯)।

মানুষের বিপদে এগিয়ে এসে তার জন্য খরচ করাকে মহান আল্লাহ বিনিয়োগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর তা তিনি বহুগুণ ফেরত দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর সালাত কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। আর তোমরা নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু আগে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তররূপে।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৪৫)। এই আয়াতে আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার অর্থ হলো তাঁর পথে খরচ করা। গরিব, অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা। পরকালে এর বিনিময় দেওয়া হবে সওয়াবরূপে।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘কিসে তোমাদের দোজখে নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে আমরা মুমিনদের দলভুক্ত ছিলাম না, আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য দান করতাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির : আয়াত ৪২-৪৪)

হজরত আবু হুরায়রা ও হজরত ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যখন অন্য মুসলমানের উপকারের জন্য অগ্রসর হয় এবং উপকারটি সম্পন্ন করে, তখন তার মাথার ওপর ৭৫ হাজার ফেরেশতা ছায়া সৃষ্টি করে দেন। এই ফেরেশতারা তার জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করতে থাকেন। উপকারটা সকালে করা হলে বিকাল পর্যন্ত দোয়া চলতে থাকে, আর বিকালে করা হলে সকাল পর্যন্ত দোয়া চলতে থাকে। আর ওই ব্যক্তির প্রত্যেক কদমে একটি করে গোনাহ মাফ হয় এবং একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।’ (ইবনে হিব্বান মুনজিরি : হাদিস ৩৮৬৮)।

এছাড়া হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত মুসলিম শরিফের ২৫৬৯ নম্বর হাদিসে এসেছে, অসহায় মানুষকে খাওয়ালে পরালে সেবা করলে তা আল্লাহ তায়ালা পেয়ে থাকেন। কবি আবদুল কাদির তার ‘মানুষের সেবা’ কবিতার মাধ্যমে হাদিসটির চমৎকার কাব্যরূপ দিয়েছেন:

“হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান! তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান। মানুষ বলিবে- তুমি প্রভু করতার আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার? বলিবেন খোদা-  দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে তারি শুশ্রূষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে। খোদা বলিবেন- হে আদম সন্তান! আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান। মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু? বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে। পুনরপি খোদা বলিবেন- শোন হে আদম সন্তান! পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি, করাওনি পানি পান। মানুষ বলিবে- তুমি জগতের স্বামী তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি? বলিবেন খোদা- তৃষ্ণার্ত তোমা ডেকেছিল জল আশে তারে যদি জল দিতে তুমি তাহা পাইতে আমার পাশে।”

মানবতার নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সবসময় অসহায় ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। মদিনার আনসার সাহাবিরা মুহাজির সাহাবিদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন আল্লাহর রাসুলের এই আদর্শ লালন ও পালন করেছেন। পরবর্তী সুলতানি আমলের রাজা-বাদশারাও অসহায় মানুষদের জন্য বিভিন্ন সরাইখানা, আশ্রয়কেন্দ্র, দারুজ জিয়াফাহ, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন।

করোনাপরিস্থিতি, বন্যাপরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানা কারণে অনেকের জন্যই দুর্যোগ চলছে। কেউ চাকরি হারিয়ে, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, কেউ দৈনন্দিন কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এখন সাধ্যানুযায়ী অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের মানবিক ও ঈমানি দায়িত্ব। এতে আমাদের জন্য রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ এবং পরকালীন অজস্র সওয়াব।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম