সাতসতেরো

‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের ১০১ বছর

‘বল বীর–/বল উন্নত মম শির!/শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!/বল বীর –/বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!’

‘বিদ্রোহী’ আত্মজাগরণের কবিতা। শিকল ভাঙার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের ডিসেম্বর ‘বিদ্রোহী’ লিখলেও কবিতাটি প্রকাশ হয়েছিলো ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি। কবিতাটি সাপ্তাহিক 'বিজলী' পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়। অর্থাৎ কবিতাটি প্রকাশের ১০১তম বার্ষিকী আজ।

অবাক করা তথ্য হচ্ছে- প্রকাশের পরপরই এই কবিতাটি তুমুল পাঠকপ্রিয়তা পায়। এ কারণে পত্রিকাটি পুনর্মুদ্রণ করতে হয়। দুবারে পত্রিকাটি মোট ২৯০০০ কপি ছাপা হয়, যা ছিলো তৎকালে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। 

বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতা কবিতাটি পাঠ করেন, অনেকে কণ্ঠস্থ করেন। ঠিক এই সময়ে প্রায় দুই লাখ লোক কবিতাটি পাঠ করেন বলে অনুমিত হয়। পৃথিবীর অন্য কোনো কবির অন্য কোনো কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর এমন ঘটনার নজির নেই। সে সময় ঘরে ঘরে, হাটে-ঘাটে, মাঠে-তটে, শহরে-বন্দরে, গঞ্জে-গ্রামে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পঠিত হয়। কবিতায় বিমুগ্ধ ভারতজাতি সংগ্রামমুখর হয়ে ওঠে। 

১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে কাজী নজরুল ইসলাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজাফফর আহমেদের সাথে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে, যখন তারা কলকাতার তালতলা লেনে বসবাস করছিলেন, তখন নজরুল কবিতাটি পেনসিলে লেখেন।

মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে- এমন একটি সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাসের জয়গান ‘বিদ্রোহী’ কবিতার চরণে চরণে দেদীপ্যমান। কবিতাটিতে ১২১ বার ‘আমি’ শব্দ ব্যবহার করে কবি একটি কথারই প্রতিধ্বনি করতে চেয়েছেন যে, অসম শক্তির অধিকারী মানুষ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বপ্নের স্বাধীন দেশ বিনির্মাণ সম্ভব। 

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সৃজন’ গ্রন্থে লিখেছেন- শান্তিনিকেতন থেকে প্রত্যাবর্তনের পরে নজরুল ও মুজফ্‌ফর আহমেদের ৩/৪ সি, তালতলা লেনের বাড়িতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক ঘটনা ঘটে। একটি হলো ভারতের ‘কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠন। অপরটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা। তালতলা লেনের এ বাড়িতে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মুজফ্‌ফর আহমদ ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন এবং নজরুলের ‘ভাঙ্গার গান’ ও ‘বিদ্রোহী’ রচনা একই বাড়িতে একই সময়ের ঘটনা। কবিতাটির স্বরূপ বিশ্নেষণ করলে এটি প্রতীয়মান হয় যে, কবিতাটি মূলত সাম্যবাদের ওপর রচিত। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ও এই কবিতা রচনার সময়কাল একই হওয়াই যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক।