সাতসতেরো

মেট্রো ম্যাজিক আর নাম না-জানা শ্রমিকের কাতার বিশ্বকাপ   

‘মেসির ওপর ভরসা রাখতে শিখুন, হি ইজ ম্যাজিক’, আর্জেন্টাইন মাতিয়াস মেট্রো ছাড়ার আগে এই কথাগুলো বলে গেলেন। ওর সঙ্গেই কথা হচ্ছিল মেট্রোতে। দুজনের গন্তব্য এক- লুসাইল স্টেডিয়াম। খানিক বাদেই মেক্সিকোর বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যাচ। আর্জেন্টিনার তখন জীবন মরণ অবস্থা। মেক্সিকোর সঙ্গে জিততেই হবে, নইলে এশিয়ার আরও একটা বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্বেই শেষ হওয়ার শঙ্কা সত্যি হয়ে যাওয়ার দশা হবে। 

লুসাইলের ওই ম্যাচে পরে মেসি ম্যাজিকই দেখিয়েছেন। ওই জাদুতে পরে গোটা আর্জেন্টিনাই তো পালটে গেল। কাতার বিশ্বকাপ লোকে আর্জেন্টিনার জন্যই মনে রাখবে। লিওনেল মেসির গৌরবগাথার কথাই আগে আসবে। কিন্তু ততোবারই হয়ত ঘুরে-ফিরে আসবে কাতারের কথা। কাতারের বিশ্বকাপের কথা। এই বিশ্বকাপটাই তো বাকি সবকিছুর চেয়েও আলাদা। 

চার বছর পরপর বিশ্বকাপ যায়, বিশ্বকাপ আসে। শেষ বিশ্বকাপটাকেই লোকে ‘সেরা’ আখ্যা দেয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান-গবেষণা প্রতিদিন এগিয়ে যায়, চার বছর পরপর বিশ্বকাপে সেগুলোর ছাপ স্পষ্টই ফুটে ওঠে। তাতে শেষ বিশ্বকাপের সেরা হওয়ার কারণগুলোও মেলে। কিন্তু কাতারের বিশ্বকাপ ওটুকুতেই সীমাবদ্ধ নেই। সব ছাড়িয়ে নতুন এক নিদর্শন তৈরি করেছে কাতার। 

কাতারের ওই নিদর্শন আদর্শ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। নর্দার্ন হেমিস্ফিয়ারের শীতকালে একটা বিশ্বকাপ হয়েছে, ওই কীর্তিই বা কম কি! নভেম্বরের শেষ দিকে শীত আসি আসি করা কাতারে ভরদুপুরের গরম টের পাইয়ে দিয়েছে গ্রীষ্মে বিশ্বকাপ আয়োজনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতেই হতো আয়োজকদের। যতই স্টেডিয়ামগুলোতে এয়ারকন্ডিশনিং থাকুক, জুন-জুলাইয়ে কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন প্রায় অসম্ভব ছিল। সময় পরিবর্তন করে নভেম্বরে বিশ্বকাপ নিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত তো ছিলই, যৌক্তিকও ছিল বটে। গোটা বিশ্বও সেটা মেনে নিয়েছিল উচ্চবাচ্চ্য ছাড়াই। তবে মানবাধিকার প্রশ্নে বারবার জর্জরিত হয়েছে কাতার। বিশ্বকাপ আয়োজনের আগে, পরে বা বহুদিন পরও ওই সমালোচনা হয়ত কাতারকে সহ্যই করতে হবে। যদিও কাতার এসব মেনে নেয়নি কখনই। আর এমন একটা আয়োজনের পর আর মেনে নেওয়ার কথাও হয়ত নয়।  

মরুর দেশ। তাই দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে লোকের আনাগোণা কমই। পুরো দেশে কাতারির সংখ্যাই ৩ লাখের মতো। তাদের খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। সুক ওয়াকিফ শহরের প্রাণকেন্দ্র, রীতিমত ঢাকার নিউমার্কেটের স্বাদ ওখানে। কফিশপগুলোয় আয়েশ করে সিসা টানার চল আছে। ওই জায়গাটা জমে ওঠে সন্ধ্যার পর। দোহার স্বাদ পেতে সুক ওয়াকিফের বিকল্প নেই। তবে মেট্রোর চিত্র ভিন্ন। দোহার প্রাণের সঞ্চারই যেন এই মেট্রো স্টেশন। আর মেট্রো। 

ব্রাজিল-বলিভিয়া থেকে সেনেগাল-বুরুন্ডি, সামোয়া আইল্যান্ড থেকে ব-দ্বীপের বাংলাদেশ। বড়-ছোট, ধনী-গরিব, সবার ওই এক ঠিকানা। মেট্রো। স্টেডিয়ামগুলো তো বটেই, এই গোটা মেট্রো স্টেশনই কাতার তৈরি করেছিল বিশ্বকাপের জন্য। খেলা দেখতে যারা এসেছেন, সবার জন্য উন্মুক্ত এই মেট্রো, যাতায়াতে তাই খরচ শূন্য। দিই মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেই মিলে যায় মেট্রো, যাওয়া আসার মিলনমেলা। ভেতরের সময়টা একে অন্যের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার। সবার লক্ষ্য একটাই। ফুটবল দেখবেন, বিশ্বকাপের স্বাদ নেবেন। এতো দেশের এতো সুখী মানুষ একসঙ্গে পৃথিবীর আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। সেটা বাজি ধরেই দাবি করা যায়।  এবারের বিশ্বকাপ সে কারণেই আলাদা। সবাই একটা শহরে, এক কাতারে, এক দোহাতে। 

বর্ণিল মেক্সিকান সমর্থক, আফ্রিকান রঙ-বেরঙের আনন্দ, আরবি সুগন্ধি আর পল গ্যাসকোয়েনের ইংল্যান্ডের ৯০ বিশ্বকাপের জার্সি- সবকিছুর সমারোহ দোহার মেট্রোতে। গল্প জমে। মুগ্ধ হয়ে ষাটোর্ধ্ব এক ইউরোপিয়ান দম্পত্তি  বলে ওঠেন, এমন সুশৃঙ্খল বিশ্বকাপ আগে উপভোগ করেননি তারা। তাই শুনে ধন্যবাদের রব ওঠে পাশের কামরা থেকেও।  

বেশিরভাগ পশ্চিমাদের কাছে কাতার বিশ্বকাপ দুইরকম। কাতার যাওয়ার আগে আর কাতার যাওয়ার পরে। ইউরোপিয়ান সংবাদমাধ্যমগুলো অবশ্য বহুদিন থেকেই সোচ্চার ছিল। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও বয়কট করেছিল বিবিসি। দ্য গার্ডিয়ান বিশ্বকাপ কভার করেছে ঠিকই, কিন্তু প্রতি আর্টিকেলের মাঝে একটা করে ডিসক্লেইমারও ছাপা হয়েছে। তবে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে, শৃঙ্খলা নিয়ে কাতার কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেয়নি। যারা এসেছেন তাদের বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়নি, উলটো সুখস্মৃতি নিয়ে ফেরত গেছেন। কাতারের সাফল্য এখানেও।     

এই বিশ্বকাপটা আর কেবল কাতারের একার হয়ে থাকেনি। রুপান্তর হয়েছে গোটা আরবের বিশ্বকাপে। আরবদের আধিক্য তো ছিলই, সঙ্গে চোখে পড়ার মতো ছিল ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ মুভমেন্ট। কাতারের আমিরের পরিবার থেকে শুরু করে ফিফার স্বেচ্ছাসেবক বা দর্শক, সব শ্রেণীর মানুষের হাতেই দেখা মিলেছে একটা আর্মব্যান্ড। ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ লেখা তাতে। এমন দৃশ্য আপনি ব্রাজিলের বিশ্বকাপে দেখবেন না, রাশিয়ার বিশ্বকাপেও দেখেননি। 

এশিয়ার বিশ্বকাপ, ইউরোপ বিরোধীতা করবে- এ যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই রীতি এবারও চলেছে ঠিকই, কিন্তু কাতার বোধ হয় গোটা এশিয়ার পক্ষ থেকেই জানান দিয়ে গেছে ওরাও ওদের জায়গাটা আঁকড়ে ধরতে জানে। ফুটবল তো সবার। ফুটবল মিলেমিশে সবারই হয়ে গেছে। এবার সেটা হয়েছে কাতারে। কেউ কেউ রেকর্ড গড়েছেন। একই শহরে ৮ স্টেডিয়াম, সেখানেই ৬৪ ম্যাচ। টিকিট থাকলেই একদিনে সহসাই দুই ম্যাচ দেখা যায় নির্বিঘ্নে। কেউ কেউ আরও বেশিই দেখেছেন। যাতায়াতেই নেই ভোগান্তি। খেলা দেখার পূর্ণ আনন্দ বুঝি একেই বলে। 

তবে সব ছাপিয়ে জীবনের চেয়ে বড় খেলা আর কী বা আছে? যে বিমানে কাতারের পথ ধরা হয়েছিল, সেখানেই পাশের সিটে বসেছিলেন একজন। জীবিকার টানে যার প্রবাস ঠিকানা কাতার। মেসি-রোনালদো-নেইমারদের নিয়ে তার তেমন আগ্রহ নেই। একটু আক্ষেপই আছে বটে। দোহা থেকে সরিয়ে তাদেরকে নিয়ে রাখা হয়েছে বাইরের এক শহরে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায়। বিশ্বকাপের ক’টা দিন এই লোকগুলোর জীবনাচরণ আড়ালেই রাখতে চেয়েছে কাতার। ওই ভদ্রলোকের খোঁজ আর মেলেনি। 

ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়াতেও অবশ্য বড় ফ্যান জোনের ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালের প্রবাসী শ্রমজীবিরা সেখানে খেলা দেখতে পেরেছে। নিখাঁদ বিনোদন নিয়ে ফিরেছেন। আবার কারও কারও খেলাই দেখা হয়নি কাজের তাগিদে। এই তো জীবন। 

যে দেশে থাকেন সেখানেই বিশ্বকাপ। পেটের দায়ে খেলা দেখায় হয়ত ছেদ পড়েছে। কতো লোকের জীবন বাজি রাখা কাজের বিনিময়ে লুইসাইলের মতো চোখ ধাঁধানো স্টেডিয়াম নির্মাণ হয়েছে, সেই স্টেডিয়ামে লিওনেল মেসি কথা রেখেছেন। ম্যাজিকই দেখিয়েছেন। মেট্রোতে মাতিয়াস যা বলে গিয়েছিলেন তাই পরে সত্যি হয়েছে। নাম না-জানা পাশের সিটে বসা বিমানের সেই ভদ্রলোক হয়ত ঐশী বাণী দিয়ে যাননি। আক্ষেপই করেছিলেন। কিন্তু মেসি যখন বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরেছেন নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও কারও মুখে বিড়বিড় করে বেরিয়ে গেছে, ‘এই ছাদের ঢালাইটাই তো আমার হাতে দেওয়া’। 

মেসির কানে সে কথা পৌঁছাবে না। কাতারও মনে রাখবে না। কিন্তু সবমিলে কাতারের বিশ্বকাপ লোকে স্মৃতিতে তুলে রাখবে পরম যত্নে। লিওনেল মেসিও রাখবেন, নাম না জানা সেই শ্রমিকও রাখবেন। 

লেখক: সাংবাদিক, টি স্পোর্টস, কাতার বিশ্বকাপ কাভার করেছেন