সাতসতেরো

লিলি খান: ভাষা-আন্দোলনের গৌরবময় সৈনিক

লিলি খান ১৯৪৭-৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় করে তোলার পেছনে তাঁর অবদান রয়েছে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের এই যৌথ সভায় অন্যান্যদের সঙ্গে আনোয়ারা খাতুন ও  লিলি খান উপস্থিত ছিলেন। 

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় আন্তর্জাতিক যুব সম্মেলনে সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে লিলি খান অংশ  নেন। এ সময় তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক গণপরিষদের ভাষার তালিকায় ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বক্তব্য দেন। 

লিলি খানসহ যুব সম্মেলনে যোগদানকারী সদস্যরা কলকাতায় ২৮ ফেব্রুয়ারিতে এক বিবৃতিতে নাজিমুদ্দীনের গণপরিষদের উক্তির প্রতিবাদ করেন এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানান। সেদিন তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, গণ-পরিষদের সরকারি ভাষা তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া, পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাক টিকেটে বাংলা ব্যবহার না করা ও নৌবাহিনীতে নিয়োগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়ার প্রতিবাদে এবং অবিলম্বে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা রূপে ঘোষণা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হবে।

তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যুক্ত রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটি নামে যে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, লিলি খান তাতে অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত সদস্য হিসেবে ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের কর্মসূচিতে একটি মিছিলের সামনের সারিতে অবস্থান নিয়ে মিছিল পরিচালনা করেন। ১১ মার্চের আন্দোলন এবং পরবর্তী কয়েক দিনের আন্দোলনে বহু ছাত্রী, অংশগ্রহণ করে।

এ প্রসঙ্গে ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনের আরেক নেত্রী বেগজাদী মাহমুদা নাসির এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘটের জায়গা ছিল প্রধান গেট। মেইন গেটে যারা ছিল সেদিন তাদের মধ্যে অনেকেই আজ বেঁচে নেই, কে কোথায় আছে তাও আমাদের অজানা ছিল। মমতাজ বেগম (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল); ইকোনোমিক্স অনার্সে পড়তো মালেকা তারপরে ছিল সুলতানা রাজিয়া (বর্তমানে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম সাহেবের স্ত্রী) আরও কয়েকজন যারা স্মৃতিতে বেচেঁ আছেন তাদের মধ্যে অনার্সের ছাত্রী ছিল আফরোজা। এদিকে আমরা তিনজন— আমি, লিলি খান (ব্যক্তিগত জীবনে ইনি পাইলট শওকত খানের স্ত্রী ছিলেন), খালেদা খানম (ইডেন কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক) হাইকোর্টের ভিতর গিয়ে প্রধান বিচারপতি জাস্টিস এলিসের এজলাসে গিয়ে উপস্থিত। চলতি কোর্টে ঢুকে আমরা আমাদের উদ্দেশ্যটা বললাম : ‘হাইকোর্ট বন্ধ রাখতে হবে’।

জাস্টিস পাশে বসা এক ভদ্রলোককে ডেকে কি যেন বললেন। তিনি এসে আমাদের বুঝিয়ে বললেন, এভাবে হাইকোর্ট বন্ধ করা যায় না- এটা বিচারের জায়গা। আপনারা আপনাদের কথা এসেম্বলিতে পেশ করুন। অনারেবল সি. জে. বলেছেন, আপনাদের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে। আমরা ‘সরি’ বলে চলে এলাম। ... ঠিক হয়েছে পরের দিন পিকেটিং হবে। পরদিন সকাল সকাল মেয়েরা সবাই মেডিক্যাল কলেজের কোণায় চলে গেলাম। ওদিকের রাস্তাটায় সশস্ত্র পুলিশ সারিবদ্ধভাবে এসে দাঁড়ালো এর মধ্যে আমাদের গাড়িঘোড়া ফেরানোর কাজ চলছে ঠিকই। ১৪৪ ধারা জারি থাকায় ওখানে আমরা পাঁচজন মেয়ে মাত্র ছিলাম। অন্য মেয়েরা ভেতরে ছিল। এর মধ্যে হঠাৎ বোমা ফাটার মতো একটা আওয়াজ শুনলাম। শুনতেই দেখলাম, আমরা কিছু বুঝতে পারছি না কিন্তু ভিতরে একটা হৈ-হুল্লোর। যখন আমরা নিজেদের দিকে তাকালাম তখন দেখি আমরা প্যারামিলিটারী গ্রুপের একটা অংশের ঘেরাওয়ের মধ্যে। আমার পাশটা খোলা ছিল। সেখান থেকে আমি ওদের বললাম, আমার সাথে সাথে বেরিয়ে আসতে। সৈন্যরা বাধা দেয়নি। আমরা দৌড়ে মেডিক্যাল কলেজের সামনের গেটে চলে গেলাম। আমাদের ততক্ষণে চোখমুখ দিয়ে পানি পড়ছে। মেডিক্যাল কলেজের ছেলেরা মগে করে পানি নিয়ে আমাদের চোখে মুখে ছিটাতে বলল। … ঢাকায় এটাই ছিল মেয়েদের প্রথম আন্দোলন।’

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করেন। এরপর রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দল ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়। ওই প্রতিনিধি দলে নারী প্রতিনিধি হিসেবে লিলি খান উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই তিনি ১৯৪৭-৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় অধ্যায়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। 

লিলি খান ১৯২৭ সালের ১২ মার্চ ঢাকার হাটখোলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। 

গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী