সাতসতেরো

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিমাত্রায় ব্যবহারে হতে পারে যেসব সমস‌্যা

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ পরিবার ও সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চায়। কারণ এর মাধ্যমেই তারা নিজেদের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে পারে, পাশাপাশি দলবদ্ধভাবে শত্রুর মোকাবিলাও করতে পারে। 

মানুষ একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে নিজের উদ্বেগ এবং বিষন্নতা কমাতে পারে, আত্মমূল্য বাড়িয়ে তুলতে পারে, নিজেকে আরাম ও আনন্দ দিতে পারে এবং একাকীত্ব প্রতিরোধ করতে পারে। অপরদিকে, শক্তিশালী সামাজিক সংযোগের অভাব মানুষের মন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক শৃংখলা ধ্বংস, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধ ঘটানোর জন্যও এই সামাজিক সংযোগের অভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই সময়ে মানুষ সামাজিক সংযোগ বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন ধরণের সামাজিক মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, টিকটক, লাইকি এবং ইউটিউবের মতো জনপ্রিয় মাধ্যম ব্যবহার করছে। কিন্তু এর অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের মন ও চিন্তাজগতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ফিয়ার অব মিসিং আউট (ফোমো) বা হারিয়ে ফেলার ভয়ের মতো নানাবিধ সামাজিক সমস্যা।

যখন কোনো ব্যক্তি সামাজিক মাধ্যমে অতিমাত্রায় আসক্ত হয়ে পড়ে তখন তারা কোন অবস্থাতেই আকর্ষণীয় বা দর্শক পছন্দ করবে এমন মুহুর্তগুলো হারাতে চায় না। সে সবার আগে সর্বশেষ অবস্থা সবাইকে জানাতে চায়। মুহূর্তগুলো হারাতে না চাওয়ার প্রবণতাই হচ্ছে ফিয়ার অব মিসিং আউট বা ফোমো। অর্থাৎ ফিয়ার অব মিসিং আউট হলো পিছিয়ে পড়ার ভয়; অন্যরা সব সুখ পেয়ে গেল, প্রচারের সমস্ত আলো অন্যদের উপরে পড়লো, সমস্ত উত্তেজনা অন্যরা পোহাইয়া নিলো, সকল আলোচনার কেন্দ্রে অন্যরা থাকলো— সর্বক্ষণের এই আশঙ্কাই হচ্ছে ফোমো। অক্সফোর্ড ডিকশানারিতে ফিয়ার অফ মিসিং আউট বা FOMO-র অর্থ কোথাও কোনো আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাপূর্ণ ইভেন্ট থেকে বাদ পড়ার অ্যাংজাইটি বা আশঙ্কা। যেমন- সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো ইভেন্ট সম্পর্কে জানার পর, মনে হতে পারে আপনাকে বাদ দিয়ে কেউ কোনো ইভেন্টে অংশগ্রহণ করছে বা আপনি সেই নির্দিষ্ট ইভেন্টটিতে উপস্থিত না-থাকায় পিছিয়ে পড়েছেন। এই চিন্তাভাবনা থেকে উদ্বিগ্নতার শুরু হয়। সামাজিক মাধ্যমের অতিমাত্রায় ব্যবহার জীবনে একঘেয়েমী নিয়ে আসে। দিনের অধিকাংশ সময় এ সামাজিক মাধ্যমেই ব্যয় হয়। ফলে সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে তারা নিজেদের বিরত রাখে। কারণ তখন তাদের মধ্যে ফেয়ার অব মিসিং আউট বা ফোমো এর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। 

কয়কেদিন আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা দিয়ে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। গত বছরের ৪ জুন শনিবার রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ফলে বিস্ফোরণে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে। এ ঘটনায় প্রায় ৪৯ জন প্রাণ হারান এবং আহত হন অনেকে। কিন্তু জেলা প্রশাসনের দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘বিস্ফোরণের ঠিক কয়েক সেকেন্ড আগে যারা ভিড়িও ধারণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ করেছেন তাদের বেশির ভাগই প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ দগ্ধ হয়েছেন’। গণমাধ‌্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, আরেফিন নামে এক তরুণ যে কিনা ওই কারখানারই শ্রমিক ছিলো এবং আগুন লাগার পরে সে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন কিন্তু ফেসবুকে লাইভ করার সময় বিস্ফোরণে সে দগ্ধ হয়ে নিহত হন এবং সে ঘটনার পুরোটাই তার লাইভে ধরা পড়ে। 

আরেফিন বা তার মত অন্যান্য তরুণেরা যারা ঘটনাটা ফেসবুকে লাইভ করছিলো তারা আসলে কেউই মুহূর্তটা হারাতে চাচ্ছিলেন না। তারা সবাই ঘটনাটা সবার আগে সবাইকে জানাতে চান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের পরিণতিটা হয় ভয়াবহ। এমনইভাবে সমাজে যারা অতিমাত্রায় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন তারা এর পরিণতিতে নিজে মানসিক অবসাদগ্রস্ততায় ভোগেন, পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করেন, কখনও কখনও সামাজিক অপরাধের মতো গুরুতর বিষয়ে জড়িয়ে পড়েন। 

গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের  সহকারী অধ্যাপক এবং ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয় (এমার্স্ট)-এর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের পিএইচডি গবেষক শামসুল আরেফীন বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক ব্যক্তির পরিচয় নির্মাণে লুকিং গ্লাস সেল্ফের মত কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে,  ফেসবুকের মত ভার্চুয়াল কমিউনিটি ‘আমাকে’ (me) কীভাবে দেখতে চায়  সেটি বিশেষ করে তরুণদের ক্ষেত্রে ‘আমি’ (I) নির্মাণের অন্যতম অনুকল্প হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। ফলে ব্যক্তির নিজেকে ( উন্নত হওয়া) প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাওয়ার এই যে প্রবণতা তা তাকে ফেসবুকে সবসময় সচল থাকতে বলে। এই সচলায়তন যে ব্যক্তিকে প্রযুক্তির দাস  ও পণ্যে রূপান্তরিত করছে সেটি তার বেনজরেই থেকে যায়। এর প্রভাব দুঃখজনকভাবে হলেও অত্যন্ত নেতিবাচক। বিশেষকরে প্রাচ্যের পরিপ্রেক্ষিতে- যেখানে পরিবার হচ্ছে একক ইউনিট- এরকম মানসিক বৈকল্যপনা পরিবার কাঠামোয় ভাঙন এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে বলে আমার ধারণা। এ নিয়ে নতুন নতুন সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় হলেও সমাজে এটির প্রভাব ব্যাপক। সামাজিক মাধ্যমের অতিমাত্রায় ব্যবহার মানুষকে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামিয়েছে। এটির ফলে সবার মাঝে ফিয়ার অফ মিসিং আউট বা ফোমো'র প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। আমরা পাশে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে কথা না বলে ভার্চুয়াল জগতে দূরের কারো সঙ্গে কথা বলি। নতুন কোনো ছবি, ভিডিও, বা খবর পেলে সবার আগেই শেয়ার করতে চাই টাইমলাইনে। কিন্তু কেন? বাস্তব জীবনের থেকে ভার্চুয়াল জগতকে বেশি গুরুত্ব দিই বলেই মানুষের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, সহিংসতা, পারিবারিক কলহ দেখতে পাই। সামাজিক মাধ্যমের আসক্তি থেকে বেরিয়ে না আসলে সমাজ একটি অসুস্থ প্রজন্মের হাতে বিনষ্ট হতে পারে।’

অদ্যবধি যে কয়েকটি গবেষণা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি নিয়ে হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ব্যক্তি জীবনে বিষন্নতা, উদ্বেগ, একাকীত্ব, আত্ম-ক্ষতি এবং এমনকি আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চিন্তা এমন কিছুর মধ্যে একটি শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে। তবে আমাদের দেশে এসংক্রান্ত গবেষণা এখনও অপ্রতুল। সুতরাং সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এবং গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে আরও গবেষণা পরিচালনা করবেন বলে আশা করা যায়।

লেখক:  মো. আশরাফুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞানী ও উন্নয়ন গবেষক  তাসলিমা আক্তার, স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়