সাতসতেরো

আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ এই গানটি যাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে, তিনি গানটির রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরী। খ্যাতিমান এই বরেণ্য লেখক-সাংবাদিকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। 

মাত্র একবছর আগে তিনি প্রয়াত হন। ২০২২ সালের ১৯ মে তিনি লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা যান। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সাত দশকের বেশি সময় ধরে দুই হাতে লিখে গেছেন। তার এই লেখার বেশিরভাগই ছিল রাজনৈতিক ভাষ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি যেটির জন্য সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, তা হলো একেবারে তরুণ বয়সে লেখা একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে লেখা তার সেই কবিতা।

২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে যে সর্বকালের সেরা বাংলা গান বলে যে ২০টি গানকে নির্বাচিত করেছিলেন, তার তিন নম্বরে ছিল এটি। কালজয়ী এই গান বাংলা ভাষায় তো বটেই বিশ্বের ১২টি ভাষায় এখন গাওয়া হয়।  একুশের গান রচনা গাফফার চৌধুরীর জীবনের অন্যতম একটি ঘটনা। এই গানটি তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ; যতদিন বাংলা ভাষা পৃথিবীর বুকে থাকবে। শুধু ভাষা সংগ্রাম নয়, পরে মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে এই গান প্রভাব রেখেছে। 

আবদুল গাফফার চৌধুরী দুর্দান্ত এক বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে গেছেন। নানামাত্রিক প্রতিভায় নিজেকে বিকশিত করেছিলেন তিনি। যখন যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই পেয়েছেন সাফল্য। 

জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার উলানিয়া গ্রামে। মায়ের নাম জোহরা খাতুন। বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী। বাবা ছিলেন রাজনীতি সচেতন এবং ব্রিটিশশাসিত ভারতের কংগ্রেস নেতা। 

ওয়াহেদ চৌধুরী বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সদস্য ছিলেন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের সময় তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা, মতিলাল নেহরুর সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন ওয়াহেদ চৌধুরী।

গাফফার চৌধুরী ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন। ১৯৪৬ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর তাকে চলে আসতে হয় বরিশাল শহরে। ভর্তি হন আসমত আলী খান ইনস্টিটিউটে। সে সময়ে আর্থিক অনটনের শিকার হয়ে উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন।  ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। এরপর তিনি সাংবাদিকতা করেছেন ঢাকার বিভিন্ন কাগজে। 

১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন গাফফার চৌধুরী। এ সময় তিনি মাসিক নকীবও সম্পাদনা করেন। একই বছর তিনি আবদুল কাদির সম্পাদিত 'দিলরুবা' পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই বছরই তিনি প্যারামাউন্ট প্রেসের সাহিত্য পত্রিকা মেঘনা'র সম্পাদক হন। ১৯৫৮ সালে আবদুল গাফফার চৌধুরী দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার রাজনৈতিক পত্রিকা ‘চাবুকের’ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু কিছু দিন পর সামরিক শাসন চালু হলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি মওলানা আকরম খাঁর ‘দৈনিক আজাদ'-এ সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি মাসিক ‘মোহাম্মদীর’ও স্বল্পকালীন সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি দৈনিক জেহাদ-এ বার্তা সম্পাদক পদে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি সাপ্তাহিক 'সোনার বাংলা’র সম্পাদক হন। পরের বছর ১৯৬৪ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামেন এবং অণুপম মুদ্রণ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। আবার ফিরে আসেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে 'দৈনিক আওয়াজ' বের করেন। ১৯৬৭ সালে আবার তিনি ‘দৈনিক আজাদ’-এ ফিরে যান। ১৯৬৯ সালে পত্রিকাটির মালিকানা নিয়ে সহিংস বিবাদ শুরু হলে তিনি আবার যোগ দেন ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া মারা গেলে হামিদুল হক চৌধুরীর অবজারভার গ্রুপের দৈনিক 'পূর্বদেশ’-এ যোগ দেন। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি ‘জয় বাংলা’, ‘যুগান্তর’ ও ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় কাজ করেছিলেন।

স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি সপরিবারে লন্ডনে চলে যান। সেখানে ‘নতুন দিন’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। প্রায় ৩৫টি বই লিখেছেন তিনি। 

গাফফার চৌধুরী বিদেশে অবস্থান করলেও দেশের জন্য তার টান ছিল অনেক। তিনি নিয়মিত কলাম লিখছেন ঢাকা ও কোলকাতার বিভিন্ন দৈনিকে।  তিনি দৈনিক যুগান্তরের নিয়মিত কলাম লেখক ছিলেন; আমৃত্যু লিখে গেছেন এখানে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের ওপর গাফফার চৌধুরী একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন, ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’। বঙ্গবন্ধুর ওপরেই আরেকটি চলচ্চিত্র, ‘দ্য পোয়েট অব পলিটিকস’ প্রয়োজনা করছেন তিনি।

কাজের স্বীকৃতির জন্য জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন গাফফার চৌধুরী। উল্লেখযোগ্য হল, বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক, ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার এবং স্বাধীনতা পদক (২০০৯)।