সাতসতেরো

বাঁচার আনন্দ আর প্রেম- সব দিয়েছে পীরের বাঁশি

বংশীবাদক আব্দুল হক। বয়স ৫০। ১৫ বছর বয়সে হাতে বাঁশি তুলে নিয়েছিলেন। নিজ প্রচেষ্টায় বাজানো শিখেছেন। সেই থেকে বাঁশির সুরে হেসেছেন, বাঁশি বাজিয়ে কেঁদেছেন। বাঁশিও তাকে দিয়েছে অনেক কিছু। সুরের প্রেমেই একদিন হকের সঙ্গী হয়েছিলেন তার স্ত্রী কোহিনূর। 

বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলার গাবতলি গ্রামে আব্দুল হকের ঘর-সংসার। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা তিনি। ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এখন স্ত্রীকে নিয়েই সংসার। যে সংসারের একমাত্র অর্থের যোগানদাতা বাঁশি এবং তার সুর।  

আজকাল ঢাকার ভ্রাম্যমাণ বংশীবাদক হয়ে উঠেছেন আব্দুল হক। রাজধানীর গুলশান-বনানীসহ নানা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার শ্রোতা। শ্রোতাদের মাসে অন্তত একবেলা হলেও সুর শোনাতে ছুটে যায় তিনি। বিনিময়ে শ্রোতারাও খুশি করেন তাকে। এতে যা পান তাতেই চলে সংসার। এ ছাড়াও ৩০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা দামের বাঁশি মিলবে তার কাছে। বাঁশি তিনি নিজেও বানান, কিছু সংগ্রহ করেন চকবাজার থেকে। কিছু আনেন কুমিল্লা থেকে। ঢাকার বিভিন্ন জনবহুল স্থানে বাঁশি বিক্রি করেন আব্দুল হক। শুক্রবার বিকেলে ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজে অনেক মানুষের ভিড় হয়। সেখানে প্রায়ই দেখা যায় তাকে। 

বলাবাহুল্য বাঁশির সঙ্গে শহরের বাসিন্দাদের সখ্য কম। অথচ সেখানেই বাঁশি বাজান এই শিল্পী। সকালে ১০টার দিকে কাজে বের হয়ে কমপক্ষে রাত ১২টা পর্যন্ত পথেই কাটে তার। এতে প্রতিদিন আয় হয় ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা। সপ্তাহদুয়েক এভাবে কাটানোর পর মন কাঁদে বাড়ির জন্য। ঢাকায় থাকা-খাওয়ার পরে যে কটা টাকা জমা হয়, তা নিয়েই ফিরে যান গ্রামে। 

বাঁশি নিয়ে গ্রাম-শহরে এমন চক্রাকার দৌড়ঝাঁপ কেন? জানতে চাইলে আব্দুল হক বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। তখন ঢাকায়ই থাকতাম। একটি প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতাম। তবে, বাড়ির টান, সংসার, জন্মভিটের মায়া আমাকে ঢাকায় থাকতে দেয়নি। একসময় ফিরে গেলাম গ্রামে। সেখানে বংশীবাদক হিসেবে কেটে যায় ১০ বছরেরও বেশি সময়। কিন্তু ক্রমেই গ্রামে আয় কমতে থাকে। ফলে চার-পাঁচ বছর আগে আবারো ঢাকায় ফিরে আসতে হলো।’ 

গ্রামে থাকাকালে অলস-অবসরে থাকেন না এই শিল্পী। প্রতিদিন বাঁশি নিয়ে বের হন। নিজ জেলা-উপজেলার ছোট ছোট হাট-বাজার, বাস স্ট্যান্ডে বাঁশি বাজান এবং বিক্রি করেন। বেশিরভাগ সময় যাত্রীবাহী লঞ্চে বাঁশি বিক্রি করেন আব্দুল হক। গ্রামে দিনভর আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।

শহর কিংবা গ্রামে- যেখানেই থাকুক আব্দুল হকের বাঁশি নিত্যসঙ্গী। অবশ্য এই বাঁশির জন্যই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন কোহিনূরকে। বাঁশি শুনেই হকের প্রেমে পড়েছিলেন কোহিনূর। নিজের স্ত্রীর গল্প করতে করতে আব্দুল হক জানান, স্বামীকে ভালোবাসার পাশাপাশি আজও তার স্ত্রী সমান ভালোবাসে স্বামীর বাঁশিকে। গ্রামে থাকলে স্ত্রীর সঙ্গে রাতের খাবার একসঙ্গে খাওয়া হয়। খাবার শেষে স্ত্রীকে বাঁশি বাজিয়ে শোনান। অভাব আর প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের ঘরে বাঁশি বাজে।  

যাত্রীবাহী লঞ্চে যেতে যেতে কথা হয় আব্দুল হকের সঙ্গে। বাঁশি বাজানোর ফাঁকে নানা কথা বলেন তিনি।  বাঁশি বাজালে মেলে ভালোবাসা-সম্মান আর দোয়া। প্রায়ই লঞ্চে তার থেকে ভাড়া রাখে না। বাসে ভাড়া নেয় না। রাস্তা-ঘাটে কেউ কেউ ভালোবেসে চা-নাস্তা খাওয়ান। আয়-বাণিজ্য কম হলেও এমন ভালোবাসার কারণে এ পেশা ছেড়ে দিতে পারেননি তিনি। 

কীভাবে বাঁশিকে পেশায় জড়িয়ে নিলেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন ঢাকায় চাকরি করতাম, একদিন ছুটির দিনে একটি পার্কে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলাম। সেদিন অনেকেই হাতে থাকা বাঁশিটা কিনতে চাইলেন। এরপর একদিন চকবাজার থেকে ১০০ বাঁশি কিনলাম। তারপর গামছা বিছিয়ে সেই পার্কে বাঁশি বিক্রি শুরু করলাম। দেখলাম, ৮০টি বাঁশি সেদিনই বিক্রি হয়ে গেল। লাভও ভালো হলো, মাসিক আয়ের হিসেবে যা চাকরির থেকেও বেশি। এরপর চাকরি ছেড়ে এই পথে আসলাম।  

কীভাবে বাঁশি বাজানো শিখলেন? জানতে চাইলে এই শিল্পী বলেন, আমার যখন ১৫ বছর বয়স, তখন স্থানীয় তালতলী বাজারে সেকেন্দার নামে এক ভবঘুরে ব্যক্তি রাস্তায় বাঁশি বাজাতেন। সেই ব্যক্তির চুল ছিল প্রায় দুই হাত লম্বা। অনেক শক্তি ছিল সেই চুলের। দুই থেকে তিনজনেও টেনে ধরে রাখতে পারত না। সেকেন্দারকে কোনো এক অলি (আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি) বাঁশি বাজানোর ক্ষমতা দান করেছিলেন। সেই সেকেন্দার যখন বাঁশি বাজাতেন তখন তার পেছনে আমি ঘুরতাম। একসময় তাকে আমার পীর মানলাম। একদিন সেকেন্দার আমাকে একটি বাঁশি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমিও বাঁশি বাজাও। বাজাতে বাজাতে পারবে’। 

শত অপ্রাপ্তি-অভাবের মধ্যেও আব্দুল হক হাসেন। বাঁশিই তার হাসির সাক্ষী। আব্দুল হক বিশ্বাস করেন, যে বাঁশির সুর মানুষের মন জয় করতে পারে, সেই মন থেকে নিষ্পাপ দোয়া মেলে। মানুষের এমন দোয়াই হয়ত মৃত্যুর পরেও তাকে জান্নাতবাসী করবে।