সাতসতেরো

সরকার নয়, সমাজের প্রতি ক্ষোভ মিরাদের

মিরা (২৮)। সংক্ষিপ্ত কিংবা সম্পূর্ণ নাম এতটুকুই। ঢাকার রাস্তায় বাসে-গাড়িতে চাঁদা তোলেন তিনি। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই কাজটি তিনি করেন। নিজেই বললেন কাজটি ‘ভিক্ষাবৃত্তি’। তারপরও অনিচ্ছা আর কষ্ট নিয়ে করছেন এ কাজ। দেহের কষ্টের চেয়ে বেশি কষ্ট মনে। কারণ, এমন জীবন তিনি চাননি।

মিরা একটি সামাজিক জীবন চেয়েছিলেন। সেই চাওয়া পূরণ হয়নি। জীবনের কাছে বারবার পেয়েছেন বঞ্চনা আর উপহাস। এ সমাজে অনেকেই আছেন মিরার মতো তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তারা মানুষ হয়েও যেন সমাজের কেউ নন। এ কারণে সমাজের প্রতি মিরার বেশ ক্ষোভ। কি সেই ক্ষোভ? মিরা জানালেন- এ কথাটুকুও কেউ কখনও জানতে চায়নি। 

মিরা বেশ পরিপাটি। কাজল দেয়া চোখে মায়া। মুখে মাস্ক, কপালে টিপ। পরিপাটি করে বাঁধা চুল। কণ্ঠ ছাড়া আর সব কিছুই নারীর মতো। অথচ সে নারী নয়। তৃতীয় লিঙ্গের একজন। যাকে সমাজ ‘হিজড়া’ নামে চেনে। 

ভর দুপুর। রাজধানীর মহাখালীতে বাসে উঠলেন মিরা। এর-ওর কাছে চাইলেন ১০-৫ টাকা। কিন্তু, টাকা দিতে নারাজ অনেকেই। কুড়ি টাকাও পেলেন না। এমন একদিন নয়, অহরহ এমন হয়-হচ্ছে। সেই ক্ষোভ জানিয়েই সেদিন একটু চটেছিলেন মিরা। বলছিলেন, ‘সবার পকেটে কি ঠাডা পড়ছে, আমাগো দুই-চার টাকাও দেয়া যায় না?’ ওই বাসে ছিলেন এই প্রতিবেদক। সেই সূত্রে পরিচয় আর চা-চক্র মিরার সঙ্গে। জীবন-জীবিকার আদ্যোপান্ত নিয়ে মিরা বলেছেন নানা কথা।

মিরা জানান, এই যে বর্তমান নাম, তা তার নাম নয়। জন্মের পরে তিনি ছিলেন মেয়ে। পরিণত হওয়ার কথা ছিল একজন নারী হিসেবে। তবে হয়েছেন অর্ধনারী। জন্মসূত্রে পাওয়া সেই নাম, সেই জীবন, সেই পরিচয় সবই পরিবর্তন হয়েছে, দেহের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। পিতামাতার দেওয়া সেই নাম এখন বলতে নারাজ তিনি। বলতে চাইলেন না জন্মবৃত্তান্ত কিংবা বাবা-মায়ের পরিচয়।

বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্ম পরিবেশ ও সমাজ প্রসঙ্গে মিরা বলেন, আমাদের মানুষ ভিক্ষাও দিতে চায় না। বলে- কাজ করে খেতে। ঠিক আছে কাজ করেই না হয় খাব। কিন্তু কাজ বা চাকরি দেওয়ার বেলায় তো কেউ নেই। এরপরই তার পাল্টা প্রশ্ন- হিজড়াদের কি কাজ করার সুযোগ আছে এ দেশে? আমি নিজেও কতো কাজ খুঁজেছি, পাইনি। আমাদের সমাজটাই এমন- খালি বড় বড় কথা, অথচ বাস্তবতা ভিন্ন।

মিরা বলেন, বিভিন্ন দেশে হিজড়ারা ভালোভাবে কাজ করে। অফিসেও কাজ করে। বিদেশের অনেক এয়ারপোর্টে অনেক হিজরা পূর্ণ সম্মান নিয়ে চাকরি করে। পার্লারে অগণিত হিজড়ারা কাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর ভারতে হিজড়ারা পথে পথে ভিক্ষা করে। উন্নত দেশে কি হিজড়া নেই? 

এই যে হিজড়ারা তালি বাজায়, কেউ কি জানতে চেয়েছে এর কি কারণে? এটা কষ্টের প্রতীক, দুঃখের প্রতীক। মানুষ অধিক কষ্টে যেমন বুক চাপড়ায়, হিজড়ারা তা পারে না। তারা তালি বাজায়। হিজড়ারা কেউ ফেসবুক চালালে দোষ, কিছু পোস্ট করলে খারাপ খারাপ কমেন্ট, কথা বললে অভদ্রতা, প্রতিবাদ করলে অসভ্যতা, ভিক্ষা করলে চাঁদাবাজি। কেউ যদি নিজের কষ্টে অর্জিত টাকা খরচ করে ট্রান্সজেন্ডার নারীতে পরিণত হন তাকে নিয়েও মানুষ বাজে কথা বলে। তো এরা যাবে কই? ক্ষোভ নিয়ে বলছিলেন মিরা।

মিরা বলেন, হিজড়াদের দিয়ে অনেক কাজ করানো সম্ভব। যারা বাসে চাঁদা তুলতে পারে, তারা বাসে কন্টাকটারি-হেলপারিও করতে পারে। সবাই দেখে হিজড়ারা খুব সাজে। হ্যাঁ তারা সাজে। কিন্তু এই সাজকে অন্যভাবে কাজে খাটানো যায়। যারা সাজতে পারে, তারা সাজাতেও পারে। যারা মেকআপ করতে জানে, তারা মেকআপ তুলতেও পারে। দেশে কতো নামিদামী মিডিয়া আছে, চ্যানেলগুলোতে মেকআপ আর্টিস্ট পদ আছে- মেকআপে পারদর্শী লোকবল নিচ্ছে। কিন্তু কোন চ্যানেলে কজন হিজড়া নিয়েছে? ফ্যাশন ক্লাব আছে, শুটিং সেটে মেকআপ আর্টিস্ট পদেও হিজড়াদের দিয়ে কাজ করানো সম্ভব। হিজড়াদের দিয়ে হোটেলে ওয়েটারের কাজও করানো যায়। কিন্তু মালিকরা কাজ দিতে চায় না, কাজ দেয় না। কারণ আমরা হয়তো মানুষের তালিকার বাইরে।

হিজড়ারা নিজেরাই উদ্যোক্তা কেন হচ্ছে না? বাধা কোথায়? জানতে চাইলে মিরা বলেন, আসলে সরকার- সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে আমাদের নানা বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই ভালো কিছু করার চেষ্টা করছে। তবে, একটি পার্লার, একটি ফার্ম, একটি টি স্টল কিংবা একটি খাবারের রেস্তোরাঁ চালু করতেও যে পরিমাণ ইনভেস্ট দরকার, সে পরিমাণ টাকা অনেকের কাছেই নেই। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা এই সমাজ। 

সরকার ও কর্মক্ষেত্র প্রসঙ্গে মিরা বলেন, ‘বেকারত্বের ফলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোর এই অবস্থা। এ জন্য সরকারের প্রতি আমাদের কোনো রাগ নেই। সরকার আমাদের নিয়ে যে কটি উদ্যোগ নিয়েছে, অন্য সরকার তত বার আমাদের নামও মুখে নেয়নি। ছোট এই দেশে এত জনগণ! অনেকেই বেকার। সরকার কয়টা চাকরি দেবে? দেশের এত প্রতিষ্ঠান, এত ব্যবসা কেন্দ্র, এত এনজিও, এত সব কাজ- তারা অধিকাংশই হিজড়াদের কাজ দেয় না। সরকারের প্রতি আমাদের কোনো ক্ষোভ নেই, বরং ক্ষোভ যা আছে তা এই সমাজের প্রতি।’

কথাগুলো বলেই মিরা চলে গেলেন। তার টার্গেট আরেকটি বাস। মহাখালী থেকে বনানি মিরার কাজ। এর বাইরের সীমানায় তিনি যেতে পারেন না, তাদের নিজস্ব নিয়মের কারণে। গাড়ি যায়-গাড়ি আসে, মানুষ যায়-মানুষ আসে। মিরা রাস্তার একপাশে নামেন, অন্য পাশে ছুটে যান, নতুন কোনো গাড়িতে টাকা তুলতে। পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠে, পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে। মিরার কর্মক্ষেত্রও তেমনি নিয়মসিদ্ধ। চক্রাকার নিয়মে এই ছোট্ট দূরত্বে মিরা বারংবার ঘোরে, জীবনের চাকা ঘোরাতে। যা আয় হয়, তা চলে যায় পেটের ক্ষুধা মেটাতে। রাস্তার হাজার বাসে তার ওঠা-নামা আর দৌড়ঝাঁপের জীবন, তবুও থেমেই থাকে তার-তাদের জীবনের চাকা।