সাতসতেরো

দিগন্ত বিস্তৃত মিঠামইন

কিশোরগঞ্জের মিঠামইন, ইটনা, নিকলী এবং অষ্টগ্রাম এগুলো হচ্ছে হাওরাঞ্চল। এখানে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ে বর্ষায়। দুর্ভাগ্যই বলা চলে বর্ষায় হাওর দেখা হয়নি। তবে মিঠামইনে যখন গিয়েছি তখন দেখে এসেছি অন্যরকম সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য ফসলের আর সেখানের মানুষের যাপিত জীবনের। দেখে এলাম বিস্তৃর্ণ ফসলের ক্ষেত। যেদিকে চোখ যায় মাইলের পর মাইল ফসল আর ফসল। 

হাওরাঞ্চল দেখার উদ্দেশ্যে কিশোরগঞ্জ থেকে করিমগঞ্জ পৌঁছলাম। এরপর ফেরিযোগে বালিখোলা তারপর আবার ফেরিযোগে মিঠামইন গেলাম। মনে হলো ফসলের নদীতে পৌঁছে গেছি। কোথাও কোথাও ইরি ধান লাগানো হচ্ছে, কোথাও কোথাও বিভিন্নরকম ডাল জাতীয় শস্যের আবাদ করা হচ্ছে। কিছু কিছু নিচু জায়গায় পানি জমে আছে। এই অঞ্চলের মিঠাপানির মাছের খ্যাতি সারা দেশেই আছে। নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। স্থানীয়রা পানি সেচে ফেলে মাছ ধরে। বর্ষাকালে গেলে হয়তো অন্যরকম একটা দৃশ্যের অবতারণা হতে পারতো। 

কিন্তু এর বিপরীত সৌন্দর্যই পরে বেশি উপভোগ্য মনে হলো।  এখানে পলি জমার কারণে প্রচুর ফসল ফলে। অনেক ক্ষেত্রে এই হাওরাঞ্চলকে বাংলাদেশের খাদ্যভাণ্ডার হিসেবেও অভিহিত করা হয়। বলা হয়ে থাকে এই হাওরাঞ্চল থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়- তা দিয়ে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক মাসের খাবার যোগান দেওয়া সম্ভব! 

যেহেতু পশুখাদ্যের অভাব হয় না, এই হাওরাঞ্চলে প্রচুর গবাদি পশু পালন করা হয়। এই অঞ্চলের মানুষ অনেক হাঁস পালন করেন। হাঁসগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়। সেগুলো আবার নানা রঙে রাঙানো। খুব বেশি মানুষ চোখে পড়ে না। সামাজিক প্রতিষ্ঠানও ওই অঞ্চলে তুলনামূলক কম। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আবদুল হামিদের বাড়ি মিঠামইন উপজেলার কমলাপুর গ্রামে। সেখানে গিয়ে জোহরের নামাজ পড়লাম। এরপর গেলাম অষ্টগ্রাম। এ উপজেলার মিষ্টি খুবই ভালো। বিশেষ করে রসমালাইয়ের স্বাদ ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এছাড়া অষ্টগ্রামের পনির বিখ্যাত পনির। মোঘল আমল থেকেই নাকি বিখ্যাত।

ওই অঞ্চলের রাস্তাগুলো খুবই উঁচু এবং খাড়া। নিচে নামা খুব কঠিন। তারপরেও নিচে নেমে গেলাম। পলি বিধৌত মাটি, সতেজ ফসল, মাটি আর ফসলের ঘ্রাণ সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দিল। অনেক বড় এলাকা। এখানে মানুষের অন্যরকম জীবন যাপনের দৃশ্য দেখলাম। স্থানীয় কৃষকেরা অস্থায়ী ঘর তুলে তুলে বসবাস করেন। মাইলের পর মাইল এমন দৃশ্য দেখা যায়।

একটা ঘরে গেলাম। এক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম। তার বাড়ি এখান থেকে বেশ দূরে। প্রতিদিন সেখান থেকে এসে ক্ষেতে কাজ করা সম্ভব না। তাই ফসল রোপন বা কাটার সময় হলে তারা এসব অস্থায়ী ঘরে থাকেন। নিজেরাই রান্না-বান্না করে খাওয়া দাওয়া করেন। হাওরে পানি এলে আর এমন দৃশ্য দেখা যায় না। তাদের জীবিকা পরিবর্তন হয়ে যায়। নৌকায় যাতায়াত করে। হাওরে পানি বাড়লে নৌকাডুবিতে অনেক প্রাণহানিও ঘটে। এখন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের ওপর দিয়ে পাকা সড়ক হওয়াতে দ্রুত যাতায়াতের একটা ব্যবস্থা হয়েছে। এলাকাগুলো একসূত্রে গাঁথা পড়েছে। কিন্তু বোঝাই যায় যে, বর্ষা এলে সুবিস্তৃত ফসলের মাঠ পানিতে ডুবে যায়। কূলকিনারা কিছু দেখা যায় না। হাওরের পানি নেমে গেলে সেখানেই আবার ফসল দোল খায়, ঢেউ তোলে। যেদিকে দুচোখ যায় সবুজ আর প্রশান্তি।