দোকানগুলো দেখতে কফিশপের মতো। মানুষের একাকীত্ব দূর করার জন্য তৈরি হয়েছে এইসব দোকান। নাম দেওয়া হয়েছে ‘‘মাইন্ড কনভিনিয়েন্স স্টোর’’। এই দোকান গড়ে তোলা হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার সোলে শহরে। হি কাং নামের ২৯ বছর বয়সী এক তরুণ দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানীতে একাধিক দোকান গড়ে তুলেছেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত কৃষিনির্ভর সমাজ থেকে থেকে ক্রমে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। পরিবর্তন এসেছে পরিবার ও ব্যক্তিজীবনেও। সে দেশে কয়েক দশক আগে, একই ছাদের নিচে ছয় থেকে আট সন্তানসহ বড় পরিবার দেখা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু অধুনা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের দৈনন্দিন কাজে পরিবর্তন এসেছে, নতুন নতুন পেশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী সিউলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাজের উপযুক্ত পরিবেশ। ফলে শহরমুখী হয়েছে মানুষ। গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলোর জীবন বদলে গেছে। শহরে বেশিরভাগই ভাড়া বাড়িতে থাকেন। সবকিছু অর্থের বিনিময়ে কিনতে হয় এখানে। ঘড়ির কাটার সঙ্গে মিলিয়ে কর্মঘণ্টা মিলিয়ে নিতে হয়।
এই নিয়ম মানতে গিয়ে বিয়ে আর সন্তান থেকে দূরে থাকতে চাইছেন দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণ-তরুণীরা। ফলে একা আর বয়ষ্ক মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার এক বাসিন্দা লি ইন সুক ওই পরিস্থির প্রভাব বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘‘তুমি সেই কথাটা জানো নিশ্চয়ই সেই খাবারটাই সবচেয়ে বেশি বিস্বাদ যা তোমাকে একা খেতে হয়। আমি যখন দোকানে আসা বয়স্ক মানুষদের জিজ্ঞেস করি তারা ঠিকমতো খাচ্ছেন কিনা, শুধু এই প্রশ্ন শুনেই তাদের চোখ ছলছল করে ওঠে।’’
লি ইন সুক দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরের বাসিন্দাদের একাকীত্ব দূর করার দোকানে কাজ করেন।
২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘‘শহরের প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার তরুণ, যাদের বয়স ১৯ থেকে ৩৯ বছরের মধ্যে। তারা হয় সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন, নয়তো বাড়িতে বন্দি। একই গবেষণায় বলা হয়েছে, সিউলে একক ব্যক্তির পরিবারের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে ।’’
দক্ষিণ কোরিয়ায় যখন একের পর এক মানুষ নিজেদের বাড়িতে একা মারা যাচ্ছিলেন, আর কয়েক দিন বা সপ্তাহ পরে তাদের দেহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল। তখন ‘‘ মাইন্ড কনভিনিয়েন্স স্টোর’’ গড়ে তোলা হয়। যেখানে একাকী মানুষদের স্বাগত জানানো হয়।’’
এই কনভিনিয়েন্স স্টোরের জন্য দোংদেমুনের লোকেশনটি বেছে নেওয়ার মূল কারণ এর অবস্থান নিম্ন-আয়ের আবাসনের কাছাকাছি। যেখানে বাসিন্দারা খুব ছোট ছোট ভাগ করা অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকে। অনেকেই এই দোকানে আসেন কিছুটা মুক্তির স্বাদ পেতে।
এ ব্যাপারে স্টোর ম্যানেজার লি বো-হিউন জানান, ‘‘এই স্টোরগুলো বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে সেই মানুষদের জন্য, যাদের অন্য কোথাও স্বাগত জানানো হয় না। এখানে শুধু বসার জায়গা আর সিনেমা দেখার সুবিধা নয় বরং গরমের দিনে কম আয়ের মানুষদের জন্য বিনামূল্যে এয়ার কন্ডিশনিংয়েরও ব্যবস্থা থাকে, যাদের ঘরে এটি চালানোর সামর্থ্য নেই ।’’
এই স্টোরগুলোকে এমন একটি স্থান হিসেবেও তৈরি করা হয়েছে, যেখানে একাকী মানুষরা সাহায্য চাওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক লজ্জা এড়াতে পারেন। দোকানের নাম ইচ্ছাকৃতভাবে ‘কনভিনিয়েন্স স্টোর’ রাখা হয়েছে। এর কারণ হলো, যাতে মানুষের মনে মানসিক স্বাস্থ্য ক্লিনিকের ভাবনা না আসে।
উল্লেখ্য, কোরিয়ায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সাহায্য চাওয়াকে এখনও কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয়।
তথ্যসূত্র; বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান