সাতসতেরো

বিজয় দিবসে বইমেলায় পাঠকের ঢল, মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্য নিয়ে প্রাণবন্ত আড্ডা

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয় বিজয় বইমেলা ২০২৫। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় সকাল থেকেই মেলায় ছিল পাঠকের উপচে পড়া ভিড়। মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্য নিয়ে পাঠক-লেখকদের আলোচনায় মেলা পরিণত হয় এক উৎসবমুখর মিলনমেলায়।

গত ১০ ডিসেম্বর থেকে বিজয় বইমেলা শুরু হয়েছে। চলবে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। 

পাঠকের আগ্রহ ও বিক্রিতে সন্তোষ: মেলায় আগত পাঠকদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাসের বইয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখা গেছে। পাশাপাশি সাহিত্যভিত্তিক বইও দেদারসে বিক্রি হয়েছে। বিভিন্ন স্টলে লেখক, পাঠক ও ইনফ্লুয়েন্সারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রকাশকদের মতে, অন্যান্য দিনের তুলনায় মঙ্গলবার বই বিক্রি ছিল বেশ সন্তোষজনক। পরিবার-পরিজন নিয়ে আসা দর্শনার্থীরা বই কেনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আয়োজনও উপভোগ করেন। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির উদ্যোগে দর্শনার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধ ও সাহিত্য নিয়ে বিশেষ আলোচনা: বিজয় মঞ্চে গতকাল অনুষ্ঠিত হয় 'সমকালীন বাংলা সাহিত্য এবং মুক্তিযুদ্ধ' শীর্ষক বিশেষ আলোচনা সভা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মুহাম্মদ আহসান নাহিয়ান। আলোচনায় অংশ নেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সাদাত হোসাইন ও সুহান রিজওয়ান। দুই লেখকই বিজয় দিবসে মেলায় উপস্থিত হতে পেরে আনন্দ প্রকাশ করেন।

ইতিহাস ও ফিকশন প্রসঙ্গে সুহান রিজওয়ান: আলোচনায় কথাসাহিত্যিক সুহান রিজওয়ান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তাঁর প্রিয় বই হিসেবে জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' এবং মঈদুল হাসানের 'মূলধারা একাত্তর'-এর নাম উল্লেখ করেন।  ইতিহাস ও গল্পের সম্পর্ক নিয়ে তিনি বলেন, “ফিকশন বা গল্প কখনোই ইতিহাসের মাপকাঠি হতে পারে না। ফিকশনে লেখকের স্বাধীনতা থাকে।”

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, অনেক ফিকশনে দেখা যায় জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিতেছে। তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে লেখকরা সচরাচর এমন স্বাধীনতা নেননি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমাদের ইতিহাস নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে। এর মধ্যবর্তী বা সঠিক অবস্থান অনেক সময় পাওয়া যায় না। পড়ার নিয়ম নিয়ে তিনি বলেন, পাঠককে কীভাবে পড়তে হবে, তা নিয়ে কোনো উপদেশ দেওয়া উচিত নয়।”

মুক্তিযুদ্ধের বই ও আবেগ প্রসঙ্গে সাদাত হোসাইন: সাদাত হোসাইন তাঁর আলোচনায় শহীদুল্লাহ কায়সারের 'সংশপ্তক' বইয়ের কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন,“ এই বই দিয়েই তাঁর মুক্তিযুদ্ধের বই পড়া শুরু। তবে তিনি মন্তব্য করেন, মানুষকে বই পড়ানো বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন কাজ। সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা বইগুলোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, “গত কয়েক বছরে মুক্তিযুদ্ধের বইগুলো অনেকটা দায়সারাভাবে লেখা হয়েছে। এগুলো পাঠকের মনে গভীর দাগ কাটতে পারছে না। ফরাসি বিপ্লবের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “সেই সময় লেখকরা সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছিলেন বলেই মানুষ বই পড়েছিল। এবং বিপ্লবের দিকে ধাবিত হয়েছিল। ”

ইতিহাস প্রসঙ্গে সাদাত বলেন, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, অনেক মানুষ যখন একটি বিষয়ে একমত হয়, সেটাই ইতিহাস। তিনি আরো বলেন, “আমরা ইতিহাস ও সাল মুখস্থ করাই, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই সময়ের অনুভূতিটা জাগাতে পারি না। জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া আনন্দদায়ক হলে সবাই তা গ্রহণ করবে।” 

সাংস্কৃতিক আয়োজন ও নাটক: “মেলায় সাংস্কৃতিক আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না। সকালে শিশুদের জন্য ছিল আঁকিবুঁকি ও গুড্ডু টয়েস-এর খেলাধুলার আসর। সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় 'খেলার শৈশব' ও পেন্টোমাইম মুভমেন্টের মূকাভিনয়। মজার ইশকুল-এর শিশু শিল্পীরাও মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা উপস্থাপন করে। রাতে ম্যাড থিয়েটার মঞ্চস্থ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক 'ঘরে ফেরা'।” 

বুধবারের আয়োজন: আজ (১৭ ডিসেম্বর) বিজয় মঞ্চে 'বিশ্ব সাহিত্য ও দলিলে মুক্তিযুদ্ধ' বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশ নেবেন গবেষক আরিফ রহমান, লেখক ও কবি  তুহিন খান এবং গবেষক সহুল আহমদ। একই দিন সন্ধ্যা ৭টায় নজরুল মঞ্চে গান গাইবেন ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। রাত ৮টায় থাকবে মৃত্যুঞ্জয় কুমার দাস ও বিদ্যুৎ সরকারের বাঁশি বাদন। আয়োজকরা আশা করছেন, আগামী দিনগুলোতেও মেলা এমন প্রাণবন্ত থাকবে।