সাতসতেরো

‘১৬ ডিসেম্বরের পরে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে ক্যু হয়ে গেল’

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে, ওদিকে পাকিস্তানে অবস্থানগত কারণে আটকে পড়া বাঙালি সামরিক সদস্যদের দুর্দশা কঠোর বন্দিদশায় পরিণত হয়।১৯৭১ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন আবু তাহের।

অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট আবু তাহের বলেন, “১৬ ডিসেম্বরের পরে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে ক্যু হয়ে গেল। নৌবাহিনীর সেইলররা অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলো। বিয়ার, হুইস্কি, ট্রে এই সমস্ত কিছু তারা জাহাজ থেকে নদীতে ফেলে দিতে আরম্ভ করল। এমনকি, অফিসারদের মারতে আরম্ভ করে দিলো। এরপর বাঙালিদের ওপর আক্রমণাত্মক আচরণ শুরু করল। আমাদেরকে ওরা বলতে শুরু করল, ‘তোমাদের জন্য আমাদের লোক মারা গেছে।’ ইয়েল খান নামের আমার এক পাকিস্তানি কোর্সমেট আমাকে তাড়া করা শুরু করল।’’

১৬ ডিসেম্বরের পর থেকেই বিভিন্ন বেইজ থেকে বাঙালি নৌবাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন ফোর্টে বন্দি করা হয়। অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট আবু তাহেরকে বন্দি করা হয় কোহাট ফোর্টে।

অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট আবু তাহের বলেন, ‘‘কোহাট ফোর্টে একদিন পাকিস্তানি কমোডর রিজভী বক্তৃতা দেন যে, ‘তোমাদেরকে এখনো আমরা আমাদের অফিসার মনে করি। তোমাদের এই বন্দিদশার জন্য আমি দুঃখিত। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তোমরা দেশে ফিরে যেতে পারবে। কোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা তৈরি করো না। কারো কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।”

অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট আবু তাহেরের মনে ক্ষোভ ছিল। এই ক্ষোভ থেকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েই তিনি বলেন, “স্যার, আপনারা তো আমাদেরকে আপনাদের অফিসার মনে করেন, তাহলে আমাদের পরিচয়পত্র নিয়ে গেছেন কেন, এখন আমাদের পরিচয় কী? আমাদেরকে কী হিসেবে বন্দি করেছেন, আমরা কী যুদ্ধবন্দি?”

এ প্রশ্ন শুনেই রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়েন ওই কমোডর। এদিকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি ৯৩ হাজার সামরিক সদস্য যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে ছিল, তাদের বন্দিদশার জন্য বাঙালিদের ওপর রাগ ছিল পাকিস্তানি অফিসারদের। এই রাগের বহিঃপ্রকাশ হতো তাদের কথায়, আচরণে।

অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট আবু তাহেরের করা প্রশ্নের জবাবে কমোডর রিজভী স্বল্প কথায় উত্তর দেন। তিনি বলেন, “তোমাদের সৌভাগ্য আর আমার দুর্ভাগ্য যে তোমাদেরকে আমি যুদ্ধবন্দি হিসেবে পাইনি। কিন্তু ভুলে যেও না, ভারতের বন্দিশিবিরগুলোতে আমাদের সৈনিকরা মরছে শুধু তোমাদের কারণে। তোমাদের সৌভাগ্য তোমরা যুদ্ধবন্দি নও, যদি যুদ্ধবন্দি হতে তাহলে তোমরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার সুযোগ পেতে না। ক্রলিং করতে হতো। বুঝেছো।”

এসব কথা বলার পরে কমোডর রিজভী ওই স্থানে আর বেশি সময় থাকেননি। তিনি স্থান ত্যাগ করেন। কোহাট ফোর্টের বাঙালি নৌবাহিনী সদস্যদের মনে এক ধরণের আতঙ্ক আর আচরণে নীরবতা নেমে আসে। কয়েকদিন পরেই খবর আসে, কোহাট ফোর্টের বন্দিদের ট্রেনে করে লায়ালপুর জেলে নেওয়া হবে। কোহাট ফোর্টের সদস্যদের তিন ভাগে ভাগ করে লায়ালপুর জেলে নেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন বন্দি থাকার পর ১৯৭৩ সালে লায়ালপুর জেল থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে সমর্থ হন আবু তাহের। দেশে ফিরে অ্যাক্টিং সাব লেফটেন্যান্ট পদে চাকরি শুরু করেন এবং পরবর্তীতে তিনি রিয়াল অ্যাডমিরাল হন। 

সূত্র: ‘লায়ালপুর জেল এস্কেপ’ প্রকাশিতব্য পাণ্ডুলিপি থেকে