স্বাস্থ্য

‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ চারপাশে থাকলেও ছোঁয়াচে নয়

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছোঁয়াচে কো‌নো রোগ নয়। তাই এটি নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকাটা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। তারা বলছেন, ছত্রাকবাহিত এ রোগ বাংলাদেশে আগেও হয়েছে। এই ধরনের ছত্রাক প্রকৃতির সর্বত্র আছে। রোগ প্রতিরোধ কমে গেছে, এমন ব্যক্তিদের এতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

গত বছরের ২২ মে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হ‌য়ে একজন রোগীর মৃত্যু হয়। তার তিন দিন পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে ওই রোগী অন্যান্য রোগের পাশাপাশি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। শনাক্ত হওয়া আরেকজন রোগী অন্য হাসপাতালে চলে গেছেন বলেও তখন জানানো হয়।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বিষ‌য়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সমীর কুমার সাহা বলেন, ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সর্বত্র অর্থাৎ আমাদের চারপাশেই আছে। বেশি সময় ধরে ঘরে রাখা অব্যবহৃত জুতাতে যেমন এ ছত্রাক থাকতে পারে, তেমনি দীর্ঘ সময় ঘ‌রে রাখা রুটিতেও এটি সৃষ্টি হতে পারে। আবার আমা‌দের চারপাশের মাটি, গাছপালা, সার বা পচনশীল ফল বা সবজির মধ্যেও এটি থাকতে পারে। এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা না।’

তি‌নি বলেন, ‘গত বছর করোনার প্রকোপ বেশি থাকায় ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছড়ানোর কথা য‌তোটা বেশি শোনা গেছে, এই বছর সেরকম শোনা যায়নি। গত বছর বেশি রোগী হওয়ার কারণও ছিল। আমরা জানি, যেকোনো রোগে আক্রান্ত হলে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। কো‌নো রোগীর জটিল অবস্থা সৃষ্টি হলে স্টেরয়েড দেওয়া হয়, যা রোগীকে সে‌রে উঠ‌তে সহায়তা করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত রোগীকেও স্টেরয়েড দেওয়া হয় বা হচ্ছে। কিন্তু যদি এই স্টেরয়েডের পরিমাণ বেশি দেওয়া হয় তখন রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের মতো সুযোগ সন্ধানী জীবাণু সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই রোগী‌কে স্টেরয়েড দেওয়ার সময় পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছোঁয়াচে কি না, এই প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছোঁয়াচে নয় মোটেও। এ নিয়ে ভীতির কারণ নেই। খুব কম এর সংক্রমণ দেখা যায়। আক্রান্ত রোগী থেকে অন্যজনের হয় না। তবে এটি মানুষ থেকে মানুষে না ছড়ালেও ভিন্নভাবে ছড়াতে পারে। যেমন রোগীর চিকিৎসা বর্জ্য হিসেবে এটি প্রকৃতিতে গেলে সেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যদি নিরাপদ না থাকেন বা তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, তাহলে তা‌দের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যগত জটিল সমস্যায় থাকা ব্যক্তি বা যেকো‌নো রো‌গের চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহারের ফলে প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়া ব্যক্তিদের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা এ ছত্রাক নাক দিয়ে শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে সাইনাসে এবং ফুসফুসে ঢুকতে পারে। প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকা ব্যক্তির শরীরের কাটাছেঁড়া জায়গা, পোড়া জায়গা বা চামড়ায় কোনো ক্ষত থাকলে সেখানেও আক্রান্ত হতে পারে।’

এ বিষ‌য়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাদের, যা‌দের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক কম। এছাড়া ক্যানসার, এইডসে আক্রান্ত রোগীদেরও এতে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ক্যানসারে আক্রান্ত যারা রেডিও থেরাপি, কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। তাদেরও এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বংশ বা জন্মগতভাবে কেউ কম প্রতিরোধক্ষমতার অধিকারী হলে তাদেরও ঝুঁকি আছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ বছর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে তেমন আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি এখনও।’

যেহেতু প্রকৃতিতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বসবাস, তাই যেকোনো সময় এটি ছড়াতে পারে এবং মানব দেহের সংস্পর্শে আসতে পারে। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধক্ষমতার বলেই এটি আক্রমণ করলেও তেমন খারাপ কিছু হবে না ব‌লেও জানান এই চিকিৎসক।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দেশে গত বছরই প্রথম হ‌য়ে‌ছে কি না, এই বিষ‌য়ে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে এই সংক্রমণ আগেও হয়েছে। তবে সেটা সংখ্যায় কম। তাই এটি আমাদের দেশে হয় না- এমন কথা ঠিক নয়। আবার খুব ‌যে বেশি হয়, সেটাও নয়। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ মাঝে মধ্যেই আমাদের দেশে হয়। যেমন গত বছর হ‌য়ে‌ছে।’

সতর্ক ক‌রে এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘করোনা রোগীদের কারও কারও ক্ষেত্রে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এই অক্সিজেন যে‌নো জীবাণুমুক্ত হয়। শুধু ক‌রোনা রোগী নয়, যেসব রোগী‌দেরই অক্সিজেন দেওয়া হয়- তা‌দের‌কে যে‌ সিলিন্ডার, নজল বা ক্যাথেটার দিয়ে অক্সিজেন দেওয়া হবে, সেগু‌লো যে‌নো জীবাণুমুক্ত হয়, এটা নিশ্চিত কর‌তে হ‌বে।’

অধ্যাপক বে-নজির বলেন, ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস চোখ ও নাক দিয়ে মানব‌ দে‌হের ভেত‌রে প্রবেশ করতে পারে। চোখ থেকে আবার মস্তিষ্কেও চলে যেতে পারে। মস্তিষ্কে চ‌লে গেলে এটা প্রাণঘাতী হ‌য়ে উঠ‌তে পা‌রে।’

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বিষ‌য়ে ব্যক্তি পর্যায়ে বেশি সতর্ক হওয়া উচিত তাদের, যারা করোনাকালে স্টেরয়েড পেয়েছেন। করোনাকালে যেসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হ‌লে তাদের এসব পালন করতে হবে। মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়ার বিধি মানতে হবে। বিশেষ করে বাইরে থেকে এসে হাত অবশ্যই ধুতে হবে ব‌লেও জানান এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।