আন্তর্জাতিক

১ মিনিটেই সব শেষ!

রাসেল পারভেজ : মাত্র এক মিনিট। সেকেন্ডের হিসাবে এর চেয়ে বেশি নয়। এর মধ্যেই ঝুপঝুপিয়ে ঝরে পড়ল বহু ভবন, স্থাপনা। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে, আঘাতে প্রাণ গেল অসংখ্য মানুষের। এই এক মিনিটেই অতীত হয়ে গেল শত শত বছরের অনেক ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনা। যেন এক মিনিটে রচিত হলো এক মৃত্যুপুরীর গল্প। এই গল্প নেপালের।

 

ভূমিকম্পের জীবন নেই। আছে জীবন নেওয়ার শক্তি। মহাপরাক্রমী সে। ভূপৃষ্ঠের নিচে তার উন্মত্ত অবস্থান। যখন গর্জে ওঠে তখন তার বিনাশী নাচুনিতে ধ্বংসের কাঁপন সৃষ্টি হয়। যত বেশি শক্তিতে সে কাঁপায়, মানব সভ্যতায় মৃত্যু ও ধ্বংসের খতিয়ান ততই বড় হয়। যদি প্রশ্ন করার সুযোগ থাকত, তবে ভূমিকম্পের কাছে জানতে চাইতাম, ‘কেন এত মৃত্যু ক্ষুধা তোর?’

  কোনো প্রশ্নের সুযোগ নেই। নেই কোনো উত্তর। নেপালের রাস্তায় লাশ। হাসপাতাল-মর্গে লাশ। বাড়িতে, গাড়িতে লাশ। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। লাশের ভারে কাঁদছে নেপাল।

 

আর যারা বেঁচে আছে তাদের চোখে শঙ্কিত প্রশ্ন, ‘বেঁচে থাকাটাই কি সবচেয়ে বড় বিস্ময়?’ এই তো কিছু সময় আগে কেউ হয়তো মাকে বলেছে, বাড়ি ফিরে একসঙ্গে খাব। কেউ হয়তো সন্তানকে বলেছে, আজ তোমাকে বিশেষ উপহার দেব। ছোট্ট সোনামনির কপালে চুমু দিয়ে কোনো মা হয়তো বলেছিল, স্কুল থেকে ফিরে এলে আজ তোকে নিয়ে ঘুরতে যাব। কতজন হয়তো জন্মদিনের উৎসব নিয়ে ব্যস্ত ছিল। অনেক পূণ্যার্থী হয়তো পাপ মুক্তির আশায় মন্দির, প্যাগোডায় গিয়েছিল। তাদের কে কোথায় আছে এখন? অনেকেরই সন্ধান এখনো মেলেনি। কেউ আছে লাশের সারিতে, কেউ আছে হাসপাতালের বিছানায়। কেউ বেঁচে থাকার বিস্ময় নিয়ে আপনজনকে জাপটে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ভাসাচ্ছে চোখ।

 

এ কি তাণ্ডব! কী ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা! ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লাশের সংখ্যা। এই মৃত্যু গোনার সময় কখন, কবে শেষ হয়, তা কে জানে! হায় রে সর্বগ্রাসী ভূমিকম্প!

 

অন্য দিনের মতোই ছিল শনিবারের সকাল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমে ওঠে কর্মব্যস্ততা। এদিকে সেদিকে নানা দেশের বিচিত্র পর্যটকের ঘোরাঘুরি। হোটেলগুলোতে সেই চিরচেনা রূপ। কেউ আসছে, হয়তো পাততাড়ি গুঁটিয়ে কেউ যাচ্ছে। নেপালের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য আর হিমালয়ের শুভ্রতার টানে প্রতিদিন হাজারে হাজার বিদেশি মানুষের আনাগোনা হয় নেপালে। এই তো নেপালের একদিন, প্রতিদিন। শনিবার সকালও ছিল তেমন প্রতিদিনের একদিন। কিন্তু বেলা ১১টা ৫৬ মিনিটে মাত্র এক মিনিটের জন্য হঠাৎ অচেনা হয়ে গেল নেপাল। শুকনো পাতায় ভরা গাছের কাণ্ড ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো নেপালকে ঝাঁকি দিল ভূমিকম্প। আর ঝরা পাতার মতো ঝুপঝুপিয়ে পড়তে লাগল ভবন, স্থাপনা, মন্দির, প্যাগোডা। গুঁড়িয়ে গেল ভগবানের মূর্তি, রাজা-মহারাজার স্মৃতির কায়া।

 

শনিবার দিবাগত রাত ২টা পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। সঠিকভাবে গণনা করা এখনো সম্ভব হয়নি। ফলে সঠিক সংখ্যাটায় কতজনের নাম থাকবে তা কে জানে! তবে উদ্ধার অভিযান চলছে। ভারত সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করছে। নেপালের পাশে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বাংলাদেশসহ অনেক দেশ ও বড় বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা।

 

গত ৮০ বছরে এত বেশি প্রাণহানি নেপালে আর হয়নি। এত শক্তিশালী ভূমিকম্পও হয়নি। বিশেষ করে জনবহুল কাঠমান্ডু ভ্যালিতে। প্রায় ২৫ লাখ মানুষের বসবাস এই ভ্যালিতে। কিন্তু ভবনগুলো সে অর্থে ভূমিকম্প সহনশীল নয়। ফলে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে গেছে। পর্যটন নগরী পোখারাও হয়ে উঠেছে মৃত্যুর শহর। এই অবস্থায় নেপালের পাশে থাকাই মানবিক বিশ্বের দায়িত্ব।

 

আমাদের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, নেপালবাসীর পাশে আছে বাংলাদেশ। আশা করি, সারা বিশ্ব দাঁড়াবে নেপালের পাশে। শোক কাটিয়ে উঠার শক্তি জ্বলে উঠুক নেপালবাসীর বুকে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ এপ্রিল ২০১৫/রাসেল পারভেজ/জনি সোম