আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ১৯৫৬ সালে কিউবার জনগণের উদ্দেশে বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমরা মুক্ত হব, নয় তো শহীদ হব।’ তার এ ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে আরনেস্তো চে গুয়েভারা ‘ফিদেলের জন্য কবিতা’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। এ কবিতায় বিপ্লব, স্বদেশপ্রেম ও জীবনবাস্তবতার গভীর সংশ্লেষ ফুটে উঠেছে। ফিদেল ও চের চেতনার ঘনিষ্ঠতা বুঝতে এ কবিতাই যথেষ্ট।
ফিদেলেরজন্যকবিতা
চলো যাই অগ্নিময় প্রত্যুষে বালুকাময় আঁকা বাঁকা নির্জন পথ পেরিয়ে তোমার ভালোবাসার সবুজ স্বপ্নময় দেশের মুক্তির জন্য।
চলো যাই জমাট বাঁধা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে আমাদের ললাটে অসংখ্য বিদ্রোহের তারা জ্বলছে শপথের বহ্নিতে না হয় আমরা মরব অথবা জিতব
যখন প্রথম বুলেটের শব্দে দেশ জেগে ওঠে কারুময় ঘুম থেকে আচমকা কোনো এক বালিকার মতো তখনো অবিচলিত থেকো, হে যোদ্ধা আমরা তোমার পাশেই আছি... থাকব।...
যখন তুমি জোর প্রচার করো : জমি-সংস্কার, ন্যায়, রুটি-রুজি আর স্বাধীনতার তখন আমরাও তোমার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করি : আমরাও আছি; আমাদের মুক্তির লক্ষ্যবানে যখন বিপক্ষের বন্যপশুরা হতাহত হয়: তখনো আমরা তোমার সাথে থাকি, আমাদের হৃদয় গর্বে স্ফীত হয় : আমরা সেখানে আছি।
বিপক্ষের সজ্জিত সৈন্যের নেকড়ে আক্রমণে আমাদের প্রস্তাবিত সঙ্কল্পের ভিত কখনো টলবে না। আমরা চাই : একটি রাইফেল, কিছু বুলেট আর লাঠিসোঁটা।
তবু যদি বিপক্ষের রাইফেলগুলো ভীষণ গর্জে ওঠে এবং ইতিহাসের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে যদি আমরা লীন হয়ে যাই তখন কেবল আমাদের এইটুকুই চাওয়া : কিউবার অশ্রু যেন যুদ্ধেমৃত সৈনিকের এক একটি কাফন হয়।
চের লেখা কবিতায় বিপ্লবের সেই মানসপুত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদপুরুষ কিউবার নন্দিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো চিরবিদায় নিলেন। কিউবানদের মহান এ নেতার সঙ্গে বিপ্লবের বরপুত্র চে গুয়েভারার আদর্শগত বোঝাপড়া ছিল দারুণ। দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কিউবা বিপ্লব সফল হয়।
ফিদেল কাস্ত্রোর জন্ম (১৯২৬) কিউবায় আর চে গুয়েভারার জন্ম আর্জেন্টিনায় (১৯২৮)। প্রায় সমবয়সি দুই বিপ্লবী নেতার হাত ধরে লাতিন আমেরিকায় কমিউনিস্ট আন্দোলন আলোর মুখ দেখে। শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম করে সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজি রেখে লড়াই করেন এ দুই নেতা।
১৯৫৫ সালে মেক্সিকোয় ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় চের। প্রথম দিনই দুজনের মধ্যে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়। গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব।
১৯৫৩ সালে মানকাডা সেনা ব্যারাকে সদলবলে হামলা চালান ফিদেল কাস্ত্রো। হামলায় পরাস্ত হয় কাস্ত্রোর বাহিনী এবং তিনি গ্রেপ্তার হন। তাকে প্রাণে মারার সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট কিউবার একনায়ক ফুলগেন্সিও বাতিস্তা প্রবল জনমতের চাপে দুই বছর কারাগারে রাখার পর তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পরে তিনি মেক্সিকোয় পাড়ি জমান এবং বিপ্লবের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
১৯৫৩ সালে পেশায় চিকিৎসক চে গুয়েভারা দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বের হন। এর দুই বছর পর তিনি মেক্সিকোয় পৌঁছান। এখানে তার সঙ্গে দেখা হয় ফিদেল কাস্ত্রোর ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর। এই সূত্র ধরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আইনজীবী ফিদেল কাস্ত্রোর। মেক্সিকো থেকে দুই বিপ্লবী নেতার যুথবদ্ধ পথচলা শুরু হয়।
ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে আলোচনার সময় চে বলেছিলেন, তিনি কিউবার সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরোধী ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিগগির এই আগ্রাসনের শেষ হওয়া প্রয়োজন।
ফিদেল ও চে পরিকল্পনা করেন মেক্সিকো থেকে কিউবার আক্রমণ করবেন। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশে রওনা দেন। কিউবায় পৌঁছানো মাত্র তারা বাতিস্তার সেনাবাহিনীর হামলার মুখে পড়েন। এ যুদ্ধে ফিদেলের ৮২ সহযোগী মারা যান অথবা কারাবন্দি হন। মাত্র ২২ জন সহযোদ্ধা প্রাণে বেঁচে ছিলেন। চের ভাষায়, এই যুদ্ধ তাকে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিণত করে।
সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতমালায় আশ্রয় নেন বিপ্লবীরা। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত গণমাধ্যম জানত না ফিদেল বেঁচে আছেন কি না। এ বছর নিউ ইয়র্ক টাইমসে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেই সঙ্গে প্রকাশিত হয় বিপ্লবীদের কাল্পনিক সব ছবি। এরপর বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব দেন চে। সিরেয়া মস্ত্রা পবর্তমালায় থাকা অবস্থায় দুঃসহ দিনগুলো সম্পর্কে চে বলেছিলেন, যুদ্ধের সবচেয়ে ব্যথার সময়। কারণ এ সময় তাদের যুদ্ধের রসদ কমে এসেছিল, সেই সঙ্গে ছিল মশার প্রচণ্ড উপদ্রব।
কিউবান বিপ্লবীদের অবিচ্ছেদ অংশ হয়ে উঠেছিলেন চে। সমাজতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে নানা দিক থেকে পরামর্শ দিতেন। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, কূটনীতি ও বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে ফিদেলের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
বিপ্লবের সময় ফিদেল বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন চেকে। বোমা তৈরির কারাখানা, রুটি সেঁকার চুল্লি তৈরি ও নিরক্ষর সহযোদ্ধাদের জন্য পাঠশালা পরিচালনার দায়িত্ব পান তিনি। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠাতা, সামরিক প্রশিক্ষণ ও পত্রিকায় বিপ্লবীদের খবর প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন চে। সব দিক থেকে ফিদেল কাস্ত্রোকে সহযোগিতা করায় টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘কাস্তোর মস্তিষ্ক’ বলে অবিহিত করেন।
ফিদেলের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবীকে সংগঠিত করে রাখতে চের ছিলেন অবিকল্প নেতা। তিনি কিউবার বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হন এবং কঠোর হাতে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করেন। ফিদেল ও চের যৌথ নেতৃত্বে ১৯৫৯ সালে পতন হয় যুক্তরাষ্ট্রপন্থি কিউবার একনায়ক বাতিস্তার। ১৯৬১ সালে ফিদেল কিউবার শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন চেকে। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্বও পালন করেন চে। ১৯৬৫ সালে আলজিয়ার্স সফরের সময় সোভিয়েত ইউনিয়কে ‘সাম্রাজ্যবাদের দোষর’ বলায় সোভিয়েত নেতাদের চাপে ফিদেল তাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেন। এরপর কিউবার বিপ্লবী রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান চে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ নভেম্বর ২০১৬/রাসেল পারভেজ