আন্তর্জাতিক

পৃথক হলো সাফা-মারওয়া

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রায় ২০ জন আছেন অপারেশন থিয়েটারে। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। কথা হচ্ছে স্রেফ ইশারায় এবং প্রতিটি পদক্ষেপই মাপা। প্রধান সার্জন হাত উঠাচ্ছেন, সহকারীরা প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি নিঃশব্দে তার হাতে তুলে দিচ্ছেন।

এটি কোনো সাধারণ বা নৈমিত্তিক অপারেশন ছিল না। বরং যুক্ত মাথা নিয়ে জন্ম হওয়া যমজ শিশু সাফা ও মারওয়াকে পৃথক করার জটিল অপারেশন। সেই সুবাদে তাদের মস্তিস্কেও করতে হয়েছে অপারেশন।

হঠাৎ করেই অপারেশেন রুমের চিত্রটি বদলে গেল। অ্যানেসথিশিয়া বিশেষজ্ঞ সতর্ক করলেন। সাফার মস্তিস্ক থেকে রক্ত ঠিকভাবে নিসৃত হচ্ছিল না। বোন মারওয়ার দিকে রক্তপ্রবাহ ঘুরিয়ে দিচ্ছিল সাফার মস্তিস্ক। এর ফলে মারওয়ার হৃদপিন্ডে চাপ বাড়ছিল এবং বিপজ্জনকভাবেই তার অবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছিল।

অ্যানেসথিশিয়া বিশেষজ্ঞ দ্রুত নির্দেশনা দিলেন। পুরো দলটি তখন দুই শিশুর শারীরিক পরিস্থিত স্বাভাবিক করতে ব্যস্ত। হঠাৎ করে এদের এক জন বলে উঠলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের শক দেওয়া প্রয়োজন।’

 

দ্রুত প্যাড বসানো হলো মারওয়ার বুকে। দুই শিশুকে যাতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় সেজন্য প্রধান হাত উঁচু করলেন। বুকে চাপ দিয়েই তিনি সরে আসলেন। অপরাশেন থিয়েটারের প্রত্যেকটি লোক পিনপতন নীরবতায় অপেক্ষা করছেন। যদি মারওয়াকে তাদের হারাতে হয়, তাহলে হয়তো বাঁচানো যাবে না সাফাকেও।

পাকিস্তানের পেশওয়ারের জয়নব বিবির সাত সন্তান। এদের প্রত্যেকেরই জন্ম হয়েছে বাড়িতে। তাই সাফা-মারওয়া যখন গর্ভে আসলো তখন জয়নব বিবি এদের বাড়িতেই জন্ম দেওয়ার চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তবে আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষার পর তাকে সিজার করার পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।

সময়টা জটিল ছিল জয়নব বিবির জন্য। সাফা-মারওয়ার জন্মের দুই মাস আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাদের বাবা। হাসপাতাল থেকে জয়নব বিবিকে বলা হয়েছিল, তার অনাগত যমজ সন্তানের দেহ একসঙ্গে যুক্ত আছে। তবে দেহের কোন অংশ যুক্ত আছে তা বলতে পারেন নি চিকিৎসকরা।

২০১৭ সালের ৭ জানুয়ারি পেশওয়ারের হায়াতাবাদ হাসপাতালে যমজ সন্তানের জন্ম দেন জয়নব। অপারেশনজনিত দুর্বলতার কারণে জয়নব তার নবজাতকদের কাছ থেকে কয়েক দিন পৃথক রাখা হয়েছিল। জয়নবের শ্বশুর সাদাত হুসেইন প্রথম নাতনিদের মুখ দেখলেন এবং সেই সুবাদে তিনিই প্রথম দেখলেন তার নাতনিদের মাথা একসঙ্গে জোড়া লাগানো।

 

দুই মাস আগে ছেলে হারানো সাদাত হুসেইনের জন্য এটা ছিল আনন্দ-বেদনার মুহূর্ত। ‘তাদের দেখে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম, কিন্তু জোড়া মাথা এই শিশুদের নিয়ে আমি কী করবে সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না’ বলছিলেন তাদের দাদা।

পাঁচ দিন পর দুই কন্যাকে কোলে পেলেন জয়নব। মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য তাকে প্রথমে শিশুদের ছবি দেখানো হয়েছিল। তবে বিষন্ন হন নি জয়নব। বরং জোড়ামাথার দুই শিশুর জন্য ভালোবাসা উথলে উঠেছিল তার অন্তরে। কয়েক দিন পর মক্কার পবিত্র দুই পাহাড়ের নামে দুই শিশুর নাম রাখা হয়-সাফা ও মারওয়া।

তিন মাস বয়সে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিশু হাসপাতাল লন্ডনের গ্রেট অরমন্ডের চিকিৎসক ওয়াসি জিলানির কাছে কোনোভাবে শিশু দুটির খবর জানানো হয়। সৌভাগ্যক্রমে কাশ্মীরে জন্ম নেওয়া ডা. জিলানি সাফা-মারওয়ার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।  শিশু দুটির মাথা স্ক্যান করার পর তিনি নিশ্চিত হন, অপারেশনের মাধ্যমে এদের পৃথক করা সম্ভব। তবে এর জন্য অন্তত তাদের ১২ মাস বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

 

এরপর মাস গড়িয়ে বছর এসেছে। সাফা-মারওয়ার বয়স যখন ১৯ মাসে পড়েছে তখন ডা. জিলানির চেষ্টা ও আর্থিক সহযোগিতায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লন্ডনে।  ২০১৮ সালের অক্টোবরে প্রথম অপারেশনটি করা হয় সাফা-মারওয়ার। এর পরেরটি ছিল চার মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে। চার দফার জটিল অপারেশন শেষ পর্যন্ত পৃথক হয় সাফা ও মারওয়া। তবে এদের দুজনকে পর্যবেক্ষণের জন্য এখনো লন্ডনে রাখা হয়েছে। আগামী বছরের প্রথম দিকে হয়তো তারা নিজ দেশ পাকিস্তানে ফিরতে পারবে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুলাই ২০১৯/শাহেদ