আন্তর্জাতিক

রোহিঙ্গা আসার দুই বছর : মিয়ানমারে আটকেপড়াদের কী অবস্থা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ঠিক দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনা চৌকিতে হামলা করে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এ হামলার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। জীবন বাঁচাতে জলের স্রোতের মতো বাংলাদেশে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা।

অভিযান চালিয়ে উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমারের বেশিরভাগ রোহিঙ্গাকে তাড়ানোর পরও ২ লাখেরও মতো মানুষ রাখাইন রাজ্যে থেকে যায়, সহিংসতাকবলিত এলাকা থেকে দূরের গ্রামগুলোতে। দুই বছর হয়ে গেল, তারা এখন নতুন সংঘাতে আটকা পড়েছে বলে মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যম স্টারনিউজ রয়টার্সের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে শনিবার।

গত বছর থেকে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনের বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই করছে। ক্রমেই মারাত্মক হয়ে ওঠা এই লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে গেছে রোহিঙ্গারা। তারা এখন উভয় পক্ষের হুমকির মুখে। রাখাইনে বসবাসরত অনেক রোহিঙ্গা এ কথা জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে। আর এই পরিস্থিতি বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

বুথিংডং টাউনশিপ, যেখানে সরকারি বাহিনী এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষ দিন দিন বাড়ছে, সেখান থেকে আসা এক গ্রামবাসী টিন সুইয়ে বলেন, আমরা একেবারে তাদের যুদ্ধের ঠিক মাঝখানে পড়ে গেছি। গেল দুই বছরে আমাদের জীবনের কোনো উন্নতি হয়নি, কেবলই অবনতি, কেবলই সমস্যা।’

মিয়ানমারের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট হামলার পর দেশটির নিরপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করে তাতে সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলেছেন, সেনা অভিযানে গণহত্যা, গণধর্ষণ হয়েছে এবং তা রোহিঙ্গা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা থেকেই করা হয়েছে। সেনাবাহিনী প্রায় সব রোহিঙ্গা শরণার্থীর সব অভিযোগই অস্বীকার করে বলে আসছে, এটা ছিল সন্ত্রাসবিরোধী বৈধ ও আইনসম্মত অভিযান।

বৃহস্পতিবার, ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গার প্রত্যবাসন তৃতীয়বারের মতো ব্যর্থ হয়। কারণ, রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ফিরতে নারাজ।

মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মিন থেইন বলেন, ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় সব ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে, পুলিশ তাদের পাহারা দেবে। যদিও এ বিষয়ে সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্রকে ফোন করেও পাননি রয়টার্সের সাংবাদিক।

রাখাইনে তথ্য পাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ 

কর্তৃপক্ষ উত্তর রাখাইনে সাংবাদিক এবং মানবিক সংস্থাগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে। জুনের শেষদিক থেকে ইন্টারনেটও বন্ধ করে দিয়েছে। সবই করা হয়েছে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এড়োনোর প্রয়োজনীয়তার দোহাই দিয়ে। বিধিনিষেধের কারণে যেকোনো তথ্য যাচাই-বাছাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপও কেন্দ্রীয় এবং উত্তর রাখাইনের বেশ কয়েকজন এবং বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে রয়টার্স কথা বলেছে। কেউ কেউ বলেছে, মুসলিম গ্রামগুলোতে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটছে এবং বোমার শেল পড়ছে। আবার সরকারি বাহিনী এবং আরাকান আর্মি উভয় পক্ষ থেকে ভয়ভীতি দেখানোর ঘটনাও ঘটছে।

রাখাইনের থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দুজন বলেছে, সুযোগ পেলে তারাও বাংলাদেশে পালিয়ে আসবে। তবে যে পথ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের ঢল এসেছিল বাংলাদেশে, সেসব রুট বর্তমানে দুই পক্ষের সংঘর্ষের কারণে অনিরাপদ হয়ে গেছে।

ক্রসফায়ারে আটকা

বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধরত সরকারি সৈন্যরা উত্তর রাখাইনের মুসলিম গ্রামগুলোতে ক্যাম্প স্থাপন করেছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছে পাঁচ গ্রামবাসী। মুসলিম বাসিন্দাদের খাদ্য ও জ্বালানি কাঠ আনতে বলেন, তাদেরকে পথ দেখিয়ে বিদ্রোহীদের আস্তানা দেখিয়ে দিতে বলেন। এসবই আসলে তাদের আরাকান আর্মির প্রতিশোধের ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

রাথেংডংয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রয়টার্সকে বলেন, ‘সরকারি সৈন্যরা যদি গ্রামে থাকতে বলে আমাদের তা মেনে নিতেই হবে।’

বুথিংডং টাউনশিপের আরেকজন জানায়, সে বার্মা ভাষায় দক্ষ হওয়ায় সৈন্যরা তাকে বলেছিল, পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে। কারণ, মুসলিম জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে দরিদ্ররা রোহিঙ্গা ঢঙ্গে কথা বলে।

গ্রামবাসী জানায়, অজ্ঞাত একটি নাম্বার থেকে কল করে তাকে সতর্ক করা হয়েছিল, যারা সেনাবাহিনীকে সহায়তা করবে, তাদের ফল ভোগ করতে হবে। তাকে বলেছিল, ‘আমরা তোমাকে মেরে ফেলব, তোমাদের গ্রামও জ্বালিয়ে দেব। ’

পরে রাথেডং টাউনশিপের সিনখোন থেইন গ্রামের দুজনকে আগস্টের শুরুর দিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গ্রামটি থেকে পালিয়ে আসা একজন মুসলিম বলেন, ‘আমরা বন্দি হয়ে আছি দুই পক্ষের মাঝখানে। আমরা নিরাপদ নই। জুন থেকে গ্রামটি থেকে আমরা তিনবার পালিয়ে এসেছি। সরকার এই অঞ্চলটা নিয়ন্ত্রণই করতে পারছে না।’

সাধারণ মানুষকে হত্যার অভিযোগ নাকচ করে আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইন থু কা এজন্য মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীকে দায়ী করেছে।

সে বলেছে, ‘আমরা ওভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করি না। আমরা যতদূর শুনেছি, মিয়ানমার বাহিনী তাদের নিয়ে গেছে, হত্যা করেছে। এমন অনেক ঘটনা আগেও করেছে তারা।’

ত্রাণের ঘাটতি

২০১২ সালে মিয়ানমারে সংঘাতের সূত্রপাতের পর তাদের ক্যাম্পে থাকতে বাধ্য করায় অনেক রোহিঙ্গাই আন্তর্জাতিক অলাভজনক নানা সংস্থার ওষুধ এবং খাবারের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘাত শুরুর পর খুব কমই সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে। রাথেডংয়ের সিন কোন টেইং গ্রামের রোহিঙ্গারা বলেন, সবশেষ মে মাসে খাবার পাওয়া গিয়েছিল। চালের ঘাটতিতে আছে মানুষ।

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কাজ করে বার্মা হিউম্যান রাইট নেটওয়ার্ক। সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক খোয়ে উইন বলেন, তারা রোহিঙ্গা গ্রামের প্রবেশের রাস্তায় স্থলমাইন এবং বিস্ফোরক ডিভাইস বসিয়ে রাখার খবর পেয়েছেন।

সেভ দ্য চিলড্রেন, অক্সফামসহ ৬১টি এনজিও যৌথ বিবৃতিতে গত সপ্তাহে বলেছে, এখনো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে চলাফেরার স্বাধীনতা কিংবা মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি, বরং সাম্প্রতিক সংঘাত রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি আরো খারাপ করেছে।

অন্যদিকে, সীমান্ত বরাবর বসবাসরত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখে। সেখানে থাকা স্বজনরা কেউই তাদেরকে সেখানে ফিরতে উৎসাহ যোগায় না।

তেমনিভাবে মিয়ানমারের ভেতরেই ফেরারির মতো জীবনের কষ্ট নিয়ে আরেক রোহিঙ্গা টিন শুয়ি বলেন, সবাই পালাতে চায়। থেকে যাওয়া অল্প সংখ্যক রোহিঙ্গাকে যখন সরকার সাহায্য করতে পারে না, কীভাবে একজন বিশ্বাস করবে যে, লাখ লাখ রোহিঙ্গা ফিরলে তাদের সহায়তা করতে পারবে?’ রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ আগস্ট ২০১৯/সাজেদ/রফিক