আন্তর্জাতিক

‘নরকে’ শিনজিয়াংয়ের নারীরা

চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ শিনজিয়াংয়ের রাজধানী উরুমকিতে বাস করতেন জুমরাত দাউত। তিন সন্তানের এই জননী চীনের আইন মেনেই ২০১৮ সালে আরও একটি সন্তান নেন। তবে এর জন্য শিনজিয়াং কর্তৃপক্ষ তাকে দুই হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার জরিমানা করে। জরিমানার অর্থ পরিশোধের সময় দাউতকে জানানো হলো, জরিমানাই শেষ নয়, তাকে বাধ্যতামূলকভাবে ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার’ মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

সরকারের ওই দপ্তর থেকে দাউতকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি ক্লিনিকে। চিকিৎসক জানালেন, লাইগেশনের মাধ্যমে তাকে স্থায়ীভাবে বন্ধ্যা করা হবে। জন্মনিয়ন্ত্রণের এই স্থায়ী প্রক্রিয়ায় আর কোনো সন্তান তিনি ধারণ করতে পারবেন না।

এই গল্পটি দাউতের একার নয়। বরং বছরের পর বছর ধরে শিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলমান নারীদের বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাত্ব, সাংস্কৃতিক মতদীক্ষা এবং যৌন সহিংসতার মতো নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে।

শিনজিয়াংয়ে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি যত ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে এটি তার একটি অংশ কেবল। এই অঞ্চলের ২০ লাখের বেশি উইঘুর মুসলমানকে কারিগরী প্রশিক্ষণের নামে বন্দিশিবিরে আটক রাখা হয়েছে।

শিনজিয়াং থেকে পালিয়ে আসা আরেক নারী রহিমা মাহমুত। তিনি এখন লন্ডনে ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেসের প্রকল্প পরিচালক। তার ভাষ্যে শিনজিয়াংয়ে নারীরা ‘নরকে’ বাস করছে।

তিনি বলেন, ‘যে কোনো গণহত্যাতেই নারীরা সবসময় প্রথম লক্ষ্যবস্তু থাকে...সেখানে ব্যাপক মাত্রায় অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ ঘটছে।’

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নেতিবাচক হওয়ায় ২০১৫ সালে এক সন্তান নীতি থেকে সরে আসে চীন। তবে শিনজিয়াংয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আগে থেকেই তিন সন্তান নেওয়ার অনুমতি ছিল। সংখ্যালঘুদের বড় পরিবারের ঐতিহ্য বিবেচনায় এর অনুমতি ছিল। তবে সম্প্রতি ‘শিনজিয়াংয়ে উইঘুর জন্মহার কমিয়ে আনা অভিযান’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গর্ভনিরোধ ও বন্ধ্যাকরণের মাধ্যমে বেইজিং উইঘুর জনগোষ্ঠীর জন্মহার কমিয়ে আনতে বাধ্য করছে।

২০১৮ সালে চীনের সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, শিনজিয়াংয়ে মহিলাদের জরায়ুতে স্থাপন উপযোগী দীর্ঘমেয়াদী অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আইইউডির ব্যবহার ছিল ৮০ শতাংশ। অথচ একই সময় চীনের অন্যান্য অঞ্চলে আইউডির ব্যবহার ছিল ব্যাপক কমতির দিকে। শিনজিয়াংয়ে যখন জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য জবরদস্তি চলছি তখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সন্তান বাড়ানোর প্রচারণা চালাচ্ছিল বেইজিং।

২০১৪ সালে শিনজিয়াংয়ে তিন হাজার ২১৪টি বন্ধ্যাকরণের ঘটনা ছিল। অথচ ২০১৮ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬০ হাজার ৪৪০ এ।

২০১৫ সালে শিনজিয়াংয়ে নারীদের বোরখা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে বেইজিং। একই সময় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নারীদের ইসলামি পোশাক ছেড়ে তথাকথিত আধুনিক পোশাক পরতে চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে। নারীদের পোশাক পরিবর্তনে সরকারের ওই প্রকল্পের নাম ছিল ‘বিউটি প্রজেক্ট’।

ইউনিভাসির্টি অব কলোরাডোতে রিসার্চ ফেলো ড্যারেন বাইলার বলেন,‘পোশাকের বিষয়টি দেখভাল করতে দ্রুত চেকপয়েন্ট বসানো হয়। যেসব নারী লম্বা স্কার্ট বা জামা পরতেন কাঁচি দিয়ে সড়কেই তাদের সেই জামা কেটে দেওয়া হতো। কারণ তাদেরকে প্যান্ট ও শার্ট পরতে বলা হতো। কোমরের নিচ পর্যন্ত নামবে এমন শার্ট তারা পরতে পারবে না।’

২০১৭ সালে প্রতিবেশী কাজাখস্তান থেকে উইঘুর বংশোদ্ভূত গুলিবাখর জালিলোভা শিনজিয়াংয়ে ব্যবসায়ীক কাজে গিয়েছিলেন। তাকে হঠাৎ করে পুলিশ বন্দিশিবিরে নিয়ে যায় এবং ১৫ মাস আটক রাখে।

উইঘুর এই নারী বন্দিশিবিরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানান, তাকে কারাগারের মতো একটি কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। সেখানে ২০ জন নারী ছিলেন, যাদেরকে দুই সারিতে বসিয়ে রাখা হতো। তাদের প্রতি ১০ দিন পর নগ্ন হয়ে বন্দিশিবিরের আঙ্গিনায় হাঁটতে বাধ্য করা হতো। এই নারীদের মধ্যে ১৪ বছরের কিছু কিশোরীও ছিল। একবার এক নিরাপত্তা রক্ষী তাকে ধর্ষণ করেছিল বলে জানান জালিলোভা।

তিনি বলেন, ‘আমি ওই নিরাপত্তা রক্ষীকে প্রশ্ন করেছিলাম তোমার কি লজ্জা হয় না? তোমার কি মা-বো নেই? তুমি আমার সঙ্গে এমন আচরণ কী করে কর? সে আমাকে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার প্যাড দিয়ে আঘাত করে বলেছিল, তোমাদের মানুষের মতো দেখায় না।’