বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁকে বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র গভীর শোক প্রকাশ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাস গঠনে তাঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করেছে।
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক শোকবার্তায় বলেছে, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র গভীর শোক প্রকাশ করছে।”
তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের কথা উল্লেখ করে দূতাবাস বলেছে, “বেগম জিয়া তাঁর দেশের আধুনিক ইতিহাস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।”
চীন
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পাঠানো শোকবার্তায় খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের প্রবীণ রাজনীতিক এবং চীনা জনগণের পুরোনো বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেছেন।
চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে চীন-বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্ব ও সমন্বিত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব গড়ে উঠেছিল, যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছে।”
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে বেগম খালেদা জিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করে চীনের প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, “এ সম্পর্ক জোরদারে তাঁর ভূমিকা চীন উচ্চভাবে মূল্যায়ন করে।”
শোকবার্তায় আরো বলা হয়, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় বেইজিং। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত করতে চীন প্রস্তুত রয়েছে, যেন উভয় দেশের জনগণ আরো বেশি উপকৃত হয়।
ভারত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করে গভীর শোক জানিয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদি লিখেছেন, “ঢাকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। তাঁর পরিবার এবং বাংলাদেশের সব মানুষের প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা। সর্বশক্তিমান তাঁর পরিবারকে এই মর্মান্তিক ক্ষতি সহ্য করার শক্তি দান করুন।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরো লিখেছেন, “বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, বাংলাদেশের উন্নয়নে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান, সেইসাথে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০১৫ সালে ঢাকায় তাঁর সাথে আমার উষ্ণ সাক্ষাতের কথা আমি স্মরণ করছি। আমরা আশা করি তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং উত্তরাধিকার আমাদের অংশীদারিত্বকে পরিচালিত করবে। তাঁর আত্মা শান্তিতে থাকুক।”
পাকিস্তান
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও শোকবার্তায় খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
শাহবাজ শরীফ নিজের ‘এক্স’ অ্যাকাউন্টে শোকবার্তা প্রকাশ করে লিখেছেন, “বিএনপির চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে তাঁর আজীবনের অবদান এক স্থায়ী উত্তরাধিকার রেখে গেছে।”
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আরো লিখেছেন, “বেগম জিয়া পাকিস্তানের একজন নিবেদিতপ্রাণ বন্ধু ছিলেন। পাকিস্তান সরকার এবং পাকিস্তানের জনগণ এই শোকের মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের পাশে রয়েছে। এই কঠিন সময়ে আমাদের চিন্তাভাবনা এবং প্রার্থনা তাঁর পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে রয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার আত্মার শান্তি কামনা করুন। আমিন!”
নেপাল
নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করে গভীর শোক জানিয়েছেন।
সুশীলা কার্কি লিখেছেন, “বিএনপি চেয়ারপারসন এবং বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। নেপাল সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে, আমি তাঁর পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।”
নেপালের প্রধানমন্ত্রী আরো লিখেছেন, “বেগম জিয়া আজীবন জনসেবার এক অনন্য উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। তাঁর আপসহীন নেতৃত্ব বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রায় এক ঐতিহাসিক অধ্যায় হয়ে থাকবে। নেপালের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে, নেপাল ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর বিদেহী আত্মা চির শান্তিতে থাকুক।”
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর পরিবার এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে।
এক শোকবার্তায় বাংলাদেশে অবস্থিত ব্রিটিশ হাইকমিশন বলেছে, “বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।”
এই অত্যন্ত দুঃখজনক সময়ে হাইকমিশন তাঁর পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েছে।
জাপান
জাপান বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার অবদানের কথা স্মরণ করেছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি এক শোকবার্তায় বলেন, “বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সম্মানিত চেয়ারপারসন মহোদয়া বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি।”
রাষ্ট্রদূত জানান, জাপান বেগম জিয়ার পরিবার, বিএনপির সব সদস্য এবং বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে খালেদা জিয়ার অবদানের কথা স্মরণ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, “প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বেগম জিয়া দুইবার জাপান সফর করেছিলেন এবং দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রেখেছিলেন।”
রাষ্ট্রদূত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা ও অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য জাপান সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সবশেষে তিনি বলেন, “তাঁর বিদেহী আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক।”
জার্মানি
ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাস এক শোকবার্তায় বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রথম নারী সরকার প্রধান এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) দীর্ঘকালীন চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছে।
তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কথা স্মরণ করে দূতাবাস জানায়, “নিজের দীর্ঘ জনজীবনে বেগম জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।”
প্রয়াত এই নেত্রীর সঙ্গে জার্মানির উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের কথা স্মরণ করে বার্তায় বলা হয়, “জার্মানি তাঁর সাথে কয়েক দশকের সম্পৃক্ততার কথা স্মরণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০০৪ সালে ঢাকা সফরকালে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোশকা ফিশারের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ এবং ২০১১ সালে জার্মান প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান উলফের রাষ্ট্রীয় সফর চলাকালীন তাঁর সাথে বৈঠক।”
শোকবার্তায় আরো বলা হয়, “তিনি বছরের পর বছর ধরে জার্মানির অন্যান্য ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিদের সাথেও উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।”
“এই শোকের মুহূর্তে জার্মানি তাঁর জাতীয় জীবনের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে এবং তাঁর পরিবার, দল ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছে।”
সবশেষে বলা হয়, “জার্মানি আমাদের দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁর আত্মা শান্তিতে থাকুক।”
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে।
ইইউ এক শোকবার্তায় বলেছে, “বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আমরা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।”
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় ‘দেশনেত্রী’, ‘আপসহীন’ উপাধিতে ভূষিত বেগম খালেদা জিয়া ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।
বেগম খালেদা জিয়া লিভার, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিস ও ইনফেকশনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন। উল্লেখ্য চলতি বছর ৭ জানুয়ারি তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে তার স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি ঘটে। তিনি দেশে ফিরে আসেন। তবে বয়স প্রতিকূল থাকায় এবং নানাবিধ রোগের জটিলতার কারণে তিনি প্রায়ই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
সর্বশেষ গত ২৩ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, তিনি পূর্বের ন্যায় এবারও কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে চিরদিনের মতো না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।