সাক্ষাৎকার

বঙ্গবন্ধুর চালানো সাইকেলটি এখনো রেখেছেন ওয়াজেদ

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে রাজবাড়ী এসেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই প্রার্থীর পক্ষে বঙ্গবন্ধু সফরসঙ্গীদের নিয়ে ১৫ দিন রাজবাড়ীতেই অবস্থান করেন।

 

নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের মধুপুর গ্রামের মৃত ওমেদ আলী মন্ডলের ছেলে মো. আবদুল ওয়াজেদ মন্ডলের (৮১) ব্যবহৃত বাইসাইকেলটি নিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘুরে বেড়িয়েছিলেন রাজবাড়ীর সবুজ পথে-প্রান্তরে। দীর্ঘ ৬১ বছর ধরে পরম মমতায় ও যত্নে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত সেই বাইসাইকেলটি আগলে রেখেছেন ওয়াজেদ মন্ডল।

 

স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ওয়াজেদ মন্ডলের সংসার। রাজবাড়ীর এই কৃষক সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করেছেন রাইজিংবিডির রাজবাড়ী প্রতিনিধি সোহেল মিয়ার কাছে। প্রিয় পাঠক, তাদের সেই কথোপকথনের চুম্বক অংশ আপনাদের জন্য তুলে ধরা হলো।

 

রাইজিংবিডি : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কীভাবে?

ওয়াজেদ মন্ডল : ১৯৫৪ সাল। আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। বয়স ১৩ কি ১৪ হবে। জেলা সদরের বেলগাছি এলাকার জৌকুড়া গ্রামের মনাক্কা চেয়ারম্যান ছিলেন আমার চাচাতো ভাই। আমি আমার নতুন সাইকেলটি নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সে সময় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী ওয়াজেদ আলী চৌধুরীর পক্ষে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে রাজবাড়ী আসেন। সেখানে তার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়।

   

রাইজিংবিডি : আপনার বাইসাইকেলটি বঙ্গবন্ধু কীভাবে আপনার কাছ থেকে নিলেন?

ওয়াজেদ মন্ডল : নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে এসে বঙ্গবন্ধু যে সাইকেলটি চালাচ্ছিলেন সেটি হঠাৎ পাংচার হয়ে যায়। যেখানে এই দুর্ঘটনা ঘটে, তার পাশেই আমি সাইকেল নিয়ে একটি গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে কাছে ডেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘এই খোকা, তোর সাইকেলটি আমাকে ১৫ দিনের জন্য দে।’ আমি স্বাচ্ছন্দ্যে সাইকেলটি বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে দিই। সে সময় তিনি আমাকে তার নষ্ট সাইকেলটি দিয়ে বলেন, ‘তুই আমার এই সাইকেলটি নিয়ে ওয়াজেদ চৌধুরীর বাড়ি চলে যা।’

 

রাইজিংবিডি : আপনি কী বঙ্গবন্ধুর নষ্ট সাইকেলটি নিয়ে রাজবাড়ীতে গিয়েছিলেন?ওয়াজেদ মন্ডল : আমি ওই দিনই সূর্যনগর স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চড়ে রাজবাড়ী চলে যাই। রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে ১৫ দিন তার সঙ্গে থাকার জন্য বলেন। এ সময় কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেন, ‘তোর সাইকেলটি চালাতে খুব জুতরে।’

   

রাইজিংবিডি : ওই ১৫ দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকে আপনি কী করেছিলেন?

ওয়াজেদ মন্ডল : সেই ১৫ দিন ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে রাজবাড়ীর হেদায়েত কাজী, ফরিদপুরের ওবায়দুর রহমান এবং মাদারীপুরের জালাল মোল্লার কথা মনে আছে। বাকিদের কথা মনে নেই। আমি নিজ হাতে বাজার করে বঙ্গবন্ধুসহ তাদের রান্না করে খাইয়েছি। সে সময় আমার সঙ্গে আরো কয়েকজন ছিল, আমি এই মুহূর্তে তাদের নামও মনে করতে পারছি না।

 

রাইজিংবিডি : বঙ্গবন্ধু রাজবাড়ী ত্যাগ করার সময় আপনাকে কিছু বলেছিলেন?

ওয়াজেদ মন্ডল : বঙ্গবন্ধু রাজবাড়ী ছেড়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমাকে কাছে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘ওয়াজেদ, আমি তো চলে যাব। তুই বাড়ি চলে যা। ঠিকমতো লেখাপড়া করিস। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত হবি, মানুষকে ভালোবাসতে শিখিস। আর ঢাকায় এলে অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করবি।’

 

রাইজিংবিডি : আপনি কী ঢাকায় গিয়ে কখনো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন?

ওয়াজেদ মন্ডল : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ধানমন্ডির বাড়িতে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম একবার। আমাকে দেখামাত্রই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই ওয়াজেদ, তোর সেই বাইসাইকেলটি কোথায় আছে? আমাকে সাইকেলটি দিয়ে দে।’ আমি সাইকেলটি নিজের কাছে রাখার আবদার করলে বঙ্গবন্ধু আমাকে হেসে বলেছিলেন, ‘আমি মরে গেলে সাইকেলটি জাদুঘরে দিয়ে দিস।’

   

রাইজিংবিডি : সাইকেলটি জাদুঘরে কেন দেননি?

ওয়াজেদ মন্ডল : বঙ্গবন্ধুর এমন মর্মান্তিক মৃত্যু আমি কখনো চাইনি। তাই বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পর মনে মনে বেশ ভেঙে পড়ি। বারবার মনে হতো সাইকেলটি জাদুঘরের চেয়ে আমার নিজের কাছে থাকলেই বেশি যত্নে থাকবে। তবে এখন বয়স বেড়েছে, হয়তো আর বেশি দিন বাঁচব না। এখন আমি সাইকেলটি জাদুঘরে দিয়ে যেতে চাই। তা ছাড়া গত বছর রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মহোদয় এবং ইউএনও সাহেব এসে সাইকেলটি দেখে গেছেন। তাদের মাধ্যমে জাদুঘর বরাবর আবেদনও করা হয়েছে।

 

রাইজিংবিডি : যুদ্ধ শেষে দেখা হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে আপনি কী বলেছিলেন?

ওয়াজেদ মন্ডল : দেখা হওয়ার পর আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম, যুদ্ধের সময় রাজাকাররা আমার সবকিছু লুট করে আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রত্তুত্তরে বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার দেশকেও ওরা নিঃস্ব করে দিয়েছে রে। আমার দেশও গরিব, তুইও গরিব। ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

 

রাইজিংবিডি : সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর শোনার পর আপনার অনুভূতি কী ছিল?

 

স্মৃতির পাতা হাতড়ে কথাগুলো বলতে গিয়ে অশীতিপর বৃদ্ধ ওয়াজেদ আলী মন্ডল কেঁদে ফেলেন। তার দুচোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার কথা বলেন তিনি।

 

ওয়াজেদ মন্ডল : ওরা কীভাবে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষকে হত্যা করল, তা এই শেষ জীবনে এসেও আমি মিলাতে পারি না। আমি চাই, বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত সেসব ঘাতকদের ফাঁসি দেওয়া হোক।

 

এরপর বেশ কিছুক্ষণ তিনি কোনো কথা বলতে পারেননি। দুচোখ বেয়ে কেবলই নীরব অশ্রুপাত হতে থাকে। একটু ধাতস্থ হলে আবার কথা হয় তার সঙ্গে।

 

রাইজিংবিডি : জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আপনার চাওয়া কী?

ওয়াজেদ মন্ডল : আমি জীবনের শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছি। এখন শেষ চাওয়া বলতে, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত এই সাইকেলটি বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে পৌঁছে দেওয়া। আর বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করা। এ দুটো চাওয়া ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই আমার।

 

রাইজিংবিডি : আপনার দীর্ঘ জীবনে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মন্তব্য কী?

 

এর উত্তরে তিনি দুই লাইন কবিতা আবৃত্তি করে বলেন-

ওয়াজেদ মন্ডল : ‘রক্তে ভেজা সিক্ত মাটি-বিবর্ণ এই ঘাস, বুকের মাঝে গুমরে কাঁদে বঙ্গবন্ধুর লাশ।’ বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তান। পৃথিবীতে আর কখনো বঙ্গবন্ধু জন্ম নেবে না। সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ এ বঙ্গসন্তান বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে বেঁচে থাকবেন।

     

রাইজিংবিডি/রাজবাড়ী/১৬ আগস্ট ২০১৫/সোহেল মিয়া/সনি/এএন