সাক্ষাৎকার

‘পথশিশুদের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই’

এম এস এইচ বাধন চৌধুরীর দেশ প্রেমের গল্প এখন দিনাজপুর শহরের মানুষের মুখে মুখে। একটি নতুন স্বপ্ন পুরনের প্রত্যাশায় কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তার স্বপ্ন শিশু শ্রম ও ভিক্ষাবৃত্ততে জড়িত শিশুদের শিক্ষিত করা। এ ক্ষেত্রে অনেকটা সফলও এই তরুণ। একাই ২০ জন শিশুকে নিয়ে কাজ শুরু করলেও এখন ৭০০ স্বচ্ছাসেবী এবং ১৬৮ জন শিশুর পড়ালেখা শেখাচ্ছেন তারা।

 

সম্প্রতি জিয়ন টেকনোলজিস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও সচেতন নাগরিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এম এস এইচ বাধন চৌধুরী সঙ্গে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির হাজি মোহাম্মাদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) প্রতিনিধি মো. মোস্তাফিজুর রহমান। আলাপচারিতার চুম্বকাংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।

 

রাইজিংবিডি : সুবিধা বঞ্চিত পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার আইডিয়াটা আপনার নিকট কীভাবে আসলো?

বাধন চৌধুরী : দেশের প্রতি ভালোবাসা আমার রক্তে, হঠাৎ করে নয়। দেশের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা কিংবা স্বপ্ন আছে আর এটা তারই একটা অংশ। সুবিধা বঞ্চিত পথশিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা বহু পুরোনো। কখনো সময় সুযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুরের বড়মাঠে বেড়াতে গিয়ে আমাকে কিছু পথশিশু বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। একে বারে পা জড়িয়ে ধরে ভিক্ষা চাইতে থাকে। তখন অনুভব করলাম এদের নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া উচিৎ। এখনই এদের ন্যায়-নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া না হলে এরাই বড় হয়ে অন্যায় অপরাধ কিংবা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িয়ে পরবে। তাই তাদের ন্যায়-নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার ভার কাঁধে নিলাম। আর এটার নাম দিলাম ‘ছানাপোনার পাঠশালা’।

 

রাইজিংবিডি : পথশিশুদের কীভাবে আগ্রহী করে তুললেন?

বাধন চৌধুরী : ব্যাপারটা যতটা কঠিন ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী সহজ ছিল। আসলে প্রতিটি পরিবারই চায় তার সন্তান শিক্ষিত হবে, পড়াশুনা শিখবে। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও উপায় হতো না। তাই আমার পড়ানোর প্রস্তাবে তারা একবারের জন্য না করেননি। বরং খুশী হয়ে আগ্রহের সাথে ঠিক সময় মতো তাদের শিশুদের ‘ছানাপোনার পাঠশালায়’ পাঠিয়ে দেয়।

 

রাইজিংবিডি : এই পথ শিশুদের কতটুকু শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন?

বাধন চৌধুরী : প্রথমে ভেবেছিলাম তাদের শুধু মাত্র স্বাক্ষর জ্ঞানের পাশাপাশি ইথিকস এবং মোরালিটি শিক্ষা দিবো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমার স্বপ্ন বড় হতে থাকে এবং এখন আমার ইচ্ছা এই পথশিশুদের বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা।

 

রাইজিংবিডি : এই কাজের ফলে আপনার ব্যক্তিগত কাজের কোন ক্ষতি হয়না?

বাধন চৌধুরী : দেশের জন্য কিছু করতে পারচ্ছি সেটাই আমার সৌভাগ্য। কতজন মানুষ দেশের জন কিছু করার সুযোগ পায় বলেন। তাছাড়া আমি একজন মোটামুটি সফল উদ্যোক্তা। জিয়ন টেকনোলজিস লিমিটেডের পরিচালক এবং এর পাশাপাশি আরো দুটি লিমিটেড কম্পানির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং আমাকে ৯টা থেকে ৫ টা অফিস করতে হয় না। তাছাড়া স্বপ্নের জন্য আপনার সময় না থাকলে আপনি তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। আর আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমার কাছে সব সময়ই সময় থাকে।

 

রাইজিংবিডি : এই মহৎ কাজ করতে গিয়ে কখনো কোন সমস্যা বা বাধার সম্মক্ষিন হয়েছেন কি? আর হলে তখন কি ভুমিকায় ছিলেন?

বাধন চৌধুরী : আপনি ভালো কাজ করতে গেলে পদে পদে বাঁধা পাবেন সেটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমার আলোচনা সমালোচনা কিংবা পর্যালোচনা করতে মনে হয় একটু বেশী ভালোবাসি। প্রথম সমস্যাটাই হলো ঘরের শত্রু বিভীষণ, অর্থাৎ আমার কাছের মানুষ গুলোই আমার স্বপ্নকে বিশ্বাস করতে চায়না। তাছাড়া মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন প্রশ্নের হর হামেশাই সম্মুখীন হয়েছি।

 

যেমন প্রথমে আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন একজন সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তা মাঠে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তোমার মতলব কী? বাচ্চা পাচার করবা না কী? সেসব কথা শুনেও নীরবে কাজ করে গেছি।  আমার সফলতাই তাদের প্রশ্নের এক মাত্র উত্তর।

 

রাইজিংবিডি : প্রথমে কিভাবে ক’জন নিয়ে কাজ শুরু করেন? বর্তমানে কী অবস্থা?

বাধন চৌধুরী : এমন একটা সময় ছিলো যখন আমি একাই ছিলাম। অনেক কষ্টে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছিলাম। কিছু সেচ্ছাসেবি যদি পেতাম সেই ইচ্ছা থেকেই দিনাজপুর সরকারি কলেজে ক্যাম্পেন করে স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ করার চিন্তা করি। কিন্তু আমি সেখানে সফল হতে পারিনি। কারণ স্বয়ং অধ্যাক্ষ ও উপাধাক্ষই আমার স্বপ্নকে বিশ্বাস করেননি, ক্যাম্পেন করা হয়নি।

 

প্রথমে আমি ২০ পথ শিশুকে নিয়ে কাজ শুরু করি। তার পর দিনাজপুর সরকারী কলেজের এইচ এস সি প্রথম বর্ষের ছয় ছাত্র ছাত্রী আমার সঙ্গে যোগ দেয়। এর পর ধীরে ধীরে আমাদের কাজ দেখে অনেকেই আমার সঙ্গে এসে কথা বলে এবং আমার স্বপ্নের কথা শুনে তারাও ইচ্ছা প্রকাশ করে আমার সঙ্গে দেশের জন্য কিছু করার। এর পর আমি আদর্শ কলেজ ও কে বি এম কলেজে ক্যাম্পেন করি। ধীরে ধীরে আমাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

 

এখন দিনাজপুরের দুইটি গুরুত্বপুর্ণ স্থান, গোরে শহীদ বড় মাঠে এবং দিনাজপুর উপশহর (নিউটাউন) এ দুটি শাখায় ব্যাপক সংখ্যক পথ শিশুদের নিয়ে কাজ চলছে। বর্তমানে আমাদের ৭০০ জনের অধিক স্বেচ্ছাসেবী আছে। আগামী মাসে, অর্থাৎ ঈদের পরেই ছানাপোনার পাঠশালার আর  দুটো শাখা শুরু হতে যাচ্ছে।

 

রাইজিংবিডি : কারো নিকট কখনো কোন সহযোগিতা প্রয়োজন মনে করেননি?

বাধন চৌধুরী : এটা একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগ,তার মানে এই নয় যে আমাদের সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। সহযোগিতা তো সব সময়ই প্রয়োজন। আমার মতো অনেকেই দেশকে ভালোবাসেন। কিন্তু দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও সময়-সুযোগ হয়ে ওঠে না। এমন কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি সাহায্য পেলে আমরা আর দ্রুত গতিতে আগাতে পারবো। আপনাদের মাধ্যমে আমি সবাইকে আহ্বান করতে চাই, আসুন না একসাথে  ভবিষ্যৎ গড়ি, নতুন করে ইতিহাস লিখি। কেবল মাত্র আপনার আমার সবার সদিচ্ছাই পারে পরিবর্তন আনতে।

 

রাইজিংবিডি : এই কাজের সফলতা সম্পর্কে আপনি কতইটুকু নিশ্চিত?

বাধন চৌধুরী : আমি সচেতনতার বীজ বপন করতে চেয়েছিলাম। সেই লক্ষেই সচেতন নাগরিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেছি। আর ‘ছানাপোনার পাঠশালা’ হল আমার বপনকৃত বীজের অংকুরিত চারাগাছ। সঠিক যতেœ এই অংকুরিত চারাগাছ একদিন বড় বৃক্ষে পরিনত হবে এবং ফল দিতে শুরু করবে। সচেতনতার ফল।

 

রাইজিংবিডি : আপনার এই কাজকে আরো বেগবান করার জন্য আপনাদের কী কী প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

বাধন চৌধুরী : আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সনদ ছাড়া শিক্ষার কোনমুল্য নেই। তাই সবার আগে এই পথ শিশুদের জন্য প্রয়োজন একটা বিদ্যালয়।

 

রাইজিংবিডি : আপনি পথ শিশু ছাড়া বয়স্কদের জন্য কী করছেন এই ব্যাপারে জানতে চাই?

বাধন চৌধুরী : পথ শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তির মুল কারণ তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা। এটা দূর করার জন্যই তাদের পরিবারের মহিলাদের হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ ও সেলাইমেশিন দিয়ে নারী উদ্দোক্তা তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া ইচ্ছা আছে বয়স্কদের জন্য খুব দ্রুত স্বাস্থ্য সেবা চালু করার।

 

রাইজিংবিডি : আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?

বাধন চৌধুরী : পথশিশুদের বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশের সম্পদে পরিণত করা। তাছাড়া মানুষদের সচেতন করে গড়েতে কাজ কারার ইচ্ছা আছে, কেননা সচেতনতাই পারে।

 

রাইজিংবিডি : আপনার প্রাপ্তি কী ?

বাধন চৌধুরী : এখন পর্যন্ত আমার প্রাপ্তি হল, ১০ জন সফল নারী উদ্দোক্তা,প্রায় ২০০জন শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ ,৭০০ জনের অধিক স্বেচ্ছাসেবী পাওয়া, হাজারো মানুষের ভালবাসা এবং আত্মতৃপ্তি।

 

রাইজিংবিডি : রাইজিংবিডিকে সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

বাধন চৌধুরী : আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ অক্টোবর ২০১৫/মোস্তাফিজ/নিয়াজ/নওশের