সাক্ষাৎকার

নিজেদের তারা ‘যুদ্ধশিশু’ বলে পরিচয় দিচ্ছে

মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের সন্তানদের ‘যুদ্ধশিশু’ বলা হয়। অনেক পরিবার সেসব সন্তানদের গ্রহণ করেনি। তাদের ঠাঁই হয়নি এ দেশের স্বাধীন মাটিতে। সে সময় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ডসহ আরও কিছু দেশ যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এসব যুদ্ধশিশুদের ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে রচিত হয় একটি বই-’৭১ এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস। গবেষণামূলক বইটির রচয়িতা মুস্তফা চৌধুরী। রাইজিংবিডির পক্ষ থেকে ফজলে আজিম মুখোমুখি হয়েছিলেন এই লেখকের। তার সঙ্গে কথোপকথনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো। ফজলে আজিম : যুদ্ধ শিশুদের বর্তমান অবস্থা কী? মুস্তফা চৌধুরী : আপনারা অনেকেই জানেন, বাংলাদেশ সরকার ও রেডক্রসের সহযোগিতায় যুদ্ধ শিশুদের বিভিন্ন দেশ দত্তক নেয়। যদিও সবার তথ্য নথিতে বিস্তারিত লেখা নেই। গোপনীয়তার স্বার্থে এমনটি করা হয়েছিল। বাংলাদেশে থাকা যুদ্ধ শিশুরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। কেউ কেউ এদের ‘জারজ সন্তান’ বলেন। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন তারা পাননি। সেদিক থেকে দত্তক নেওয়া এসব শিশুরা ভালো আছেন। নিজ পরিচয়ে বড় হয়ে এখন তারা প্রতিষ্ঠিত। তাদের কেউ ডাক্তার, কেউ কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। আত্মপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়ে তারা  ভালো আছেন। ফজলে আজিম : যুদ্ধ শিশুদের দত্তক দেওয়ার প্রক্রিয়াটা কী ছিল? মুস্তফা চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদররা এদেশের মা বোনদের জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। এ সংখ্যা দুই লাখ। তবে সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। কারণ বিষয়গুলো কেউ প্রকাশ করতে চান না। ধর্ষণের শিকার অনেক অন্তঃসত্তা নারী বাড়িতেই গোপনে গর্ভপাত করেছিলেন। আবার অসংখ্য গর্ভবতী মহিলা চলে গিয়েছিলেন ভারতে কিংবা অন্য কোথাও গোপনে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রেডক্রস ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থা যুদ্ধের সময় নির্যাতিত ও ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কাজ করেছিল। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিনই গর্ভপাত করানো হতো। সেসব বীরাঙ্গনা হোমে আশ্রয় নিতেন। সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিল, যুদ্ধ শিশুদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তখন রেডক্রসসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে এগিয়ে আসে। পরবর্তীতে রেডক্রসের সহযোগিতায় কয়েকটি দেশ যুদ্ধ শিশুদের দত্তক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে। সবার আগে এগিয়ে আসে কানাডার দুটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে দুই দেশের সহযোগিতায় তা সম্ভব হয়। ফজলে আজিম : যুদ্ধ শিশুদের বিদেশে পাঠানোর কারণ কী ছিল? মুস্তফা চৌধুরী : মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধর্ষণ, খুন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এসব ছিল তখন স্বাভাবিক ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানিরা মনে করতো, এ দেশের মানুষ এখনো পরিপূর্ণ মুসলমান হয়নি। তাই তারা এদেশের কিশোরী, যুবতীকন্যা ও গৃহবধূদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের উত্তরসূরী করে রেখে যেতে চেয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন যুক্তিসঙ্গত কারণে সিদ্ধান্ত নিলেন এসব যুদ্ধ শিশুদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কারণ অনেক মা এসব শিশুদের লালনপালনের দায়িত্ব নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। সে সময় বিভিন্ন দেশ থেকে নিঃসন্তান দম্পতিরাও এসব শিশুদের গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে। ফজলে আজিম : কানাডায় কতজন যুদ্ধ শিশু বাস করছেন? মুস্তফা চৌধুরী : ১৯৭২ সালে রেডক্রসের মাধ্যমে প্রথম ১৫ জন যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেয় কানাডার দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তিনটি ধাপে এসব শিশুদের দত্তক নেয় কানাডা সরকার। প্রথম পর্যায়ে নেওয়া ১৫ শিশুর মধ্যে ছিল ৮ জন মেয়ে ও ৭ জন ছেলে। এদের সম্পর্কে সব তথ্য সে দেশের আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও দ্বিতীয় ধাপে আরও ৮ জনকে দত্তক নেওয়া হয়। এদের মধ্যে যুদ্ধশিশু ও অনাথ শিশু দুটোই ছিল। যুদ্ধের সময় বাবা-মাকে হারানো অনাথ শিশুদের মধ্যে একজন মনোয়ারা ক্লার্ক। পরবর্তী ধাপে যাদের কানাডা সরকার গ্রহণ করেছিল তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য আর্কাইভে সংরক্ষিত না থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ফজলে আজিম : কতদিন ধরে যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে গবেষণা করছেন? মুস্তফা চৌধুরী : আমি গত ২০ বছর ধরে যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে গবেষণা করেছি। এ বিষয়ে কানাডিয়ান সরকার সব রকমের প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে। যুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া এসব শিশুরা বর্তমানে তাদের জন্ম পরিচয় দেওয়ার সময় বাংলাদেশ নামটি উল্লেখ করতে সংকোচবোধ করে না। তারা বলে ‘আমরা কানাডিয়ান, বাই বর্ন বাংলাদেশি’। এদের কেউ কেউ মায়ের খোঁজে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তবে মাকে আর তারা খুঁজে পাননি। দত্তক দেওয়ার সময় অনেক বিষয়ই সুস্পষ্টভাবে লেখা ছিল না। কোনো কোনো জায়গায় লেখা ছিল যুদ্ধ শিশুর মায়ের জন্মস্থান বরিশাল। ব্যাস এতটুকুই। যা থেকে তাদের এখন আর খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। যখন এদের দত্তক দেওয়া হয় তখন কারো বয়স ছিল ১৫ দিন, ৩ মাস, ৫ মাস এমন।

   

ফজলে আজিম : বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অভিব্যক্তি কি? মুস্তফা চৌধুরী : এদের নামের প্রথম অংশ হচ্ছে এদেশে তাদের মায়ের দেওয়া নাম। সে নাম এখনো তারা ব্যবহার করছে। নামের শেষ অংশ হচ্ছে যাদের কাছে বড় হয়েছে তার নামে। যেসব পরিবারে তারা বড় হয়েছে সবাই হোয়াইট আমেরিকান। বড় হওয়ার সাথে সাথে এরা তাদের পরিচয় জানতে পেরেছে। নিজেদের তারা ‘যুদ্ধশিশু’ বলে পরিচয় দিচ্ছে। এখন তারা মাতৃস্নেহ খুঁজে পেতে চায়। কেউ কেউ কয়েকবার বাংলাদেশে গিয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে এদের আগ্রহ প্রচুর। বাংলাদেশ সম্পর্কে এরা জানতে চায়। শুনতে চায়। ফজলে আজিম : যুদ্ধশিশুদের  কিছু অনুভূতি যদি শেয়ার করেন? মুস্তফা চৌধুরী : আমার বইয়ে যুদ্ধ শিশুদের অনুভূতিগুলো ধারাবাহিকভাবে লেখা আছে। আমি সেখানে ১৫ জন যুদ্ধ শিশুর জীবন সংগ্রামের বিভিন্ন দিক বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করেছি। তাদের একজনের অনুভূতি হচ্ছে, ‘হায়েনাদের ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে আরও অনেকের মতো আমাকে যিনি জন্মের আগেই হত্যা করেননি গর্ভপাত ঘটিয়ে, সেই মহিয়সী রমণীকে ধন্যবাদ দিতে চাই। বিলম্বে হলেও মায়ের ঋণ শোধ করতে চাই। মাতৃস্নেহে আপ্লুত হতে চাই।’ আরেকজন যুদ্ধশিশু রায়ান। তার অভিব্যক্তি- ‘আমার নাম রায়ান বাদল। আমার দুইজন মা। একজন আমাকে ডাকে ‘রায়ান’ বলে। আরেকজন আমাকে ডাকতো ‘বাদল’ বলে। রায়ান বলে যিনি আমাকে ডাকেন, তাকে আমি আমার সারা জীবন ধরে চিনি। কিন্তু যিনি আমাকে বাদল বলে ডাকতেন তাকে আমি কখনো দেখিনি। তিনি আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন বাংলাদেশে। সেই জন্মের তিন সপ্তাহ পরে আবার আমি জন্মেছিলাম আমার রায়ান নামে ডাকা কানাডিয়ান মায়ের কোলে। বাদল নামে ডাকা আমার জন্মদাত্রী মাকে ১৯৭১ সালে ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তানি এক সৈন্য। আমি একজন যুদ্ধশিশু’। ফজলে আজিম : বইটি প্রকাশের পর কেমন সাড়া পেয়েছেন? মুস্তফা চৌধুরী : কানাডা থেকে প্রকাশিত দেশে-বিদেশে পত্রিকায় প্রথম যুদ্ধশিশু নিয়ে লেখালেখি শুরু করি। বিভিন্ন প্রভিন্স থেকে তখন অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। লেখালেখিতে উৎসাহ দিতেন। অনেকেই সবগুলো লেখা নিয়ে বই প্রকাশের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। ২০১৫ সালে একুশে বইমেলায় বইটির মোড়ক উন্মোচিত হয়। বইটি প্রকাশের পর ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাল্পনিক গল্প আছে। বাস্তব গল্পের সংখ্যা তুলনামূলক কম। সে দিক থেকে যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে এমন বই দেশে এই প্রথম। বাংলাভাষার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বইটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের পাঠকদের জন্য বইটি ২০১৫ সালে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। Picking Up the Pieces: 1971 War Babies’ Odyssey from Bangladesh to Canada নামে বইটি প্রকাশ করে  Xlibris, Bloomington, Indiana, USA. বাংলায় বইটি প্রকাশ করেছে একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি, ঢাকা, বাংলাদেশ। এবারের অমর একুশে বইমেলায় বইটির বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন পাওয়া যাবে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা