সাক্ষাৎকার

যুব মহিলা লীগেও শুদ্ধি অভিযান শুরু: নাজমা আক্তার

অনৈতিক কর্মকাণ্ডে আলোচনায় আসা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়ার মদতদাতা ও সঙ্গীদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি নাজমা আক্তার।

তিনি বলেন, পাপিয়ার ঘটনার পর বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়া যুব মহিলা লীগে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। শুক্রবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডি ডটকম কার্যালয়ে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি এসব বলেন।

নিচে সাক্ষাৎকারটি‍ হুবহু তুলে ধরা হলো।

রাইজিংবিডি: আপনি দীর্ঘদিন রাজনীতি আছেন। যুব মহিলা লীগের দায়িত্ব পালন করছেন। সংসদ সদস্যও ছিলেন। আপনি কীভাবে রাজনীতিতে এলেন?

নাজমা আক্তার:  আমার পরিবার হচ্ছে একটি রাজনৈতিক পরিবার।  আমার দাদা, চাচা, ভাইয়েরা—সবাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।  পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ফায়ারের শিকার হয়েছিলেন। লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সবাইকে, সেখানে আমার বাবাও ছিলেন। অনেকেই সেই ফায়ারে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাবা বেঁচে গিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ক্ষত নিয়ে বেঁচেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। চাকরি করতেন।  তাই সরাসরি রাজনীতি করতে পারতেন না। ভাইয়েরা সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন। যখন শেখ হাসিনা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন আমি টুঙ্গিপাড়ায়। ক্লাস টেনে পড়ি। ওই সময়ে টুঙ্গিপাড়া ছাত্রলীগের ছাত্রীকল্যাণ সম্পাদক ছিলাম।  নেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বিভিন্ন প্রোগ্রামে যেতাম। ১৯৮৪-৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আবাসিক ছাত্রী হিসেবে ভর্তি হলাম। রোকেয়া হল ছাত্রলীগের দুই বার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমি ১৯৮৯ সালে রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের নির্বাচিত জিএস।  ওই সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলাম।  তারপর যুব মহিলা লীগে আসা।

ছাত্রলীগ থেকে যারা সদ্য সাবেক হওয়া নেত্রীরা আছি তারা কী করবো, বিষয়টি নিয়ে নেত্রীর কাছে জানতে চাইতাম।  মহিলা লীগ আছে কিন্তু সেখানে সিনিয়ররা এত বেশি ছিলেন, তখন প্রশ্ন উঠলো—আমরা কোথায় যাবো? এজন্য তরুণ নেতৃত্ব বিকশিত করার উপলব্ধি থেকে প্রাক্তন ছাত্রনেত্রীদের দিয়ে যুব মহিলা লীগ প্রতিষ্ঠা করেন শেখ হাসিনা। ২০০২ সালের ৬ জুলাই ১০১ সদস্যবিশিষ্ট যুব মহিলা লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।  ওই কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পাই আমি।

রাইজিংবিডি: যুব মহিলা লীগ সংগঠন হিসেবে এখন কতটুকু শক্তিশালী হয়েছে বলে মনে করেন? দেশের রাজনীতিতে যুব মহিলা লীগের অবদান কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

নাজমা আক্তার: আমাদের সংগঠনে এখন ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার ৮০ ভাগ জেলায় সম্মেলন করে কমিটি করা আছে।  কিছু কিছু জেলায় আহ্বায়ক কমিটি আছে কিন্তু থানায় আমরা সম্মেলন করে কমিটি দিয়েছি। কিছু কিছু জেলায় ইউনিয়ন কমিটিও করেছি। সাংগঠনিকভাবে বিশাল একটি নেটওয়ার্ক আমাদের তৈরি হয়েছে। চাইলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুব মহিলা লীগের বড় সমাবেশ করতে পারবো।

রাইজিংবিডি: সম্প্রতি যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়ার অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।  এতে সংগঠন সম্পর্কে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।  বিষয়টি সংগঠনে কতটা প্রভাব ফেলেছে?

নাজমা আক্তার: দেখুন, পাপিয়া একটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সারাদেশে আমাদের হাজার হাজার কর্মী আছে।  শত শত কমিটি আছে। এক পাপিয়ার অপকর্ম দিয়ে সংগঠনকে বিচার করলে চলবে না। আমি মনে করি এটি সংগঠন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে একটি শিক্ষা।  এখান থেকে আমরা নিজেদের মধ্যে যে ক্ষতগুলো আছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতে পারি। এই ধাক্কার মাধ্যমে নতুন উদ্যোমে সংগঠনকে আরও বেশি শক্তিশালী করে এগোতে পারি।

রাইজিংবিডি: নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের কমিটিতে পাপিয়াকে না রাখার বিষয়ে পরামর্শ এসেছিল। সেখানে আপনারা সম্মেলন করেও কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি। পাপিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করার ক্ষেত্রে আপনারা প্রভাবিত হয়েছেন কিনা?

নাজমা আক্তার: নরসিংদীর বিষয়টি আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই। এটা একটি স্পর্শকাতর বিষয়।  এখানে এই ধরনের একটা জঘন্য ঘটনা ঘটে গেছে।  তাই কমিটি ঘোষণা করতে গিয়ে দুটি পক্ষ হয়ে যায়।  একপক্ষ একজনকে চায়, আরেক পক্ষ আরেকজনকে চায়। যুব মহিলা লীগের সভাপতি হিসেবে আমি নরসিংদী জেলার সভাপতিকে পছন্দ করেছিলাম। সেটি স্থানীয় নেতাদের সুপারিশে। তাদের পক্ষে আমি অবস্থান নিয়েছিলাম। আবার আমার সেক্রেটারি আরেকটি পক্ষের মতের ভিত্তিতে বলেছিলেন, সেক্রেটারিকে তিনি পছন্দ করেছেন। তিনি জানতেন না যে, পাপিয়া এই রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত। হয়তো তখন ছিল না। হয়তো বা ছিলও। যে কারণে বেশিরভাগই তাকে পছন্দ করেনি। সেটি হয়তো আমার সেক্রেটারি অপু উকিল বুঝতে পারেননি। যাই হোক আমরা যখন মঞ্চে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা দেবো, তখন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়।  সভাপতির নাম ঘোষণা হয়ে গেছে।  কিন্তু কেউ সেক্রেটারির নাম ঘোষণা করতে দেবেন না। ওই ঘটনার পর কমিটি ঘোষণা করতে পারিনি। তাই পরবর্তী সময়ে ঘোষণার কথা বলে ঢাকায় চলে এলাম। এরপর আবারও স্থানীয় নেতাদের ফোন। আমাদের কেন্দ্রের নিয়ম আছে যদি প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি একমত না হতে পারলে কোনো জেলার প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির নাম ঘোষণা করতে হলে একজনের নাম আমি ঘোষণা করবো, অন্যজনের নাম ঘোষণা করবেন কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি। সেটিও নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে নেই।  আমি নরসিংদী জেলার প্রেসিডিন্টের পক্ষে মত দিয়েছি।  অপু উকিল সেক্রেটারির পক্ষে মত দিয়েছেন।

এখন কথা হচ্ছে—অপু উকিল এটা করেছেন (পাপিয়ার নাম ঘোষণা) বলেই যে তারই দোষ, সেটা আমি বলবো না।  কারণ, এরকম কাজ সারা দেশে করি। আমার ক্ষেত্রেও এটি হতে পারতো। আমার কথা হচ্ছে—এই মেয়েটি এত সাহস কীভাবে পেলো? সংগঠনের কেউ না কেউ তো তাকে মদত দিয়েছে।  যারা তার সঙ্গে পারিবারিকভাবে মিশেছে, তারাও তো বলতে পারতো, আমাদের কেন্দ্রকে জানাতে পারতো।  তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। তার জেলা থেকেও কেউ আমাদের বলেনি, সে এরকম একটি সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে।

রাইজিংবিডি: পাপিয়ার ঘটনার পর আপনারা মিটিং করেছেন, কমিটি করেছেন। সারাদেশে সংগঠনকে পরিশুদ্ধ করার কাজ শুরু করেছেন। এই বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাই।

নাজমা আক্তার: যেদিন পাপিয়া গ্রেপ্তার হলো, সেদিন তাকে আমরা আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছি।  নরসিংদী জেলা কমিটি সাময়িক স্থগিত করেছি। ওখানে কোনো নারী জড়িত আছেন, কি না সেটি বের করার জন্য স্থানীয় নেত্রীদের পরামর্শ দিয়েছি।  তাদের নাম পাঠাতে বলেছি। আমরা বিভিন্ন সাংগঠনিক জেলার দায়িত্ব দিয়ে যে কমিটি করেছি, তাদের খোঁজ নিতে বলেছি। শুধু এই ধরনের অপকর্ম নয়, বিভিন্ন জায়গায় আছে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করা, জায়গা-জমি দখল করা বা অন্য অপকর্মের সঙ্গে কেউ যদি জড়িত থাকলে, তাদের নাম পাঠাতে বলেছি।

রাইজিংবিডি: পাপিয়ার ঘটনায় সংগঠনের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়ার পর আপনারা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন।  তিনি কী নির্দেশনা দিয়েছেন?

নাজমা আক্তার: এই ধরনের একটি নেতিবাচক খবরে আমরা নিজেরা শুধু মর্মাহত নই, লজ্জিতও। আমি তো মনে করি এতদিন সংগঠনটি পরিচালনা করলাম, তাহলে কি এই পর্যায়ে এসে ব্যর্থ হলাম? দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে যখন আমরা দেখা করলাম, আমার কাছে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কী খবর? আমি যা বলার বললাম।  তিনি বললেন, ‘যারা অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে জড়িত, বিষয়ে খবর নিয়ে ব্যবস্থা নাও।  আর আমার কাছে যে সব লিস্ট আছে, সেটি যাচাই-বাছাই করে চালুনি দিয়ে ছেঁকে বের করে দেবো।’

রাইজিংবিডি: আপনি প্রায় ১৮ বছর যুব মহিলা লীগের দায়িত্বে আছেন। সংগঠনকে এই পর্যায়ের আনায় আপনার অবদান অনেক। পাপিয়ার ঘটনা আপনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য একটি ধাক্কা বলে মনে করেন কি না?

নাজমা আক্তার: দেখুন আমি কেমন, আমার পরিবার জানে, আমার  দীর্ঘদিনের বন্ধু-বান্ধবরা জানে, রাজনৈতিক সহকর্মীরা জানে, বাসার দারোয়ান, কাজের লোক—সবাই জানে।  সুতরাং ব্যক্তি আমি যতই স্বচ্ছ থাকি না কেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। হয়তো তারা কেউ কেউ ভাবতে পারে যে, নাজমা আপা সংগঠনের প্রধান, তাহলে তিনি কেন এটি কন্ট্রোল করতে পারলেন না। আমাকে দায়িত্ব নিতেই হবে। সেই হিসেবে নিশ্চয় আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে একটা ক্ষতি হয়েছে। আমি শতভাগ নির্দোষ। আমি কখনো কোনো অন্যায় করিনি, কোনো অপরাধ করিনি, কোনো দুর্নীতি করিনি। বিশ্বাস রাখি, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব রিপোর্ট আছে।  আশা করবো, সেই রিপোর্ট অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।  তাহলে আমার কী ভূমিকা, তাও স্পষ্ট হবে।

রাইজিংবিডি: দীর্ঘদিন যুব মহিলার লীগের যে সুনাম ছিল, তা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন  হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আপনার বক্তব্য কী

নাজমা আক্তার: ক্ষমতা ভোগের বিষয় নয়। মানুষের সেবা করার জন্য।  ক্ষমতায় থাকার কারণে আমরা বিএনপি-জামায়াতের হাতে নির্যাতিত হচ্ছি না, এটিই পরম পাওয়া।  বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক যারা, শেখ হাসিনার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী যারা, দলকে যারা ভালোবাসেন, তাদের প্রতি অনুরোধ—দেশকে ভালোবেসে দলের আদর্শের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুন। কোনোভাবেই যেন শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, সেই দিকে খেয়াল রেখে রাজনীতি করবেন, দেশের সেবা করবেন।

রাইজিংবিডি:  রাইজিংবিডি পজিটিভ বাংলাদেশকে ধারণ করে সংবাদ পরিবেশনা করে যাচ্ছে।  রাইজিংবিডিকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এর পাঠকদের জন্য আপনার কিছু বলার আছে? নাজমা আক্তার: রাইজিংবিডির যারা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।  আমি বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস রেখে রাইজিংবিডি এগিয়ে যাবে।  সবাইকে ধন্যবাদ।

নাজমা আক্তার ২০০২ সাল থেকে যুব মহিলা লীগের দায়িত্বে রয়েছেন। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়কের দায়িত্ব পালনের পর ২০০৪ সালে যুব মহিলা লীগের প্রথম সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১১ মার্চ যুব মহিলা লীগের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে সভাপতি নির্বাচিত করেন।  ছিলেন সংসদ সদস্যও। ঢাকা/রেজা/সাইফ/নাসিম