সাক্ষাৎকার

শিল্পীদের যৌবন থাকলে কদর থাকে : কুদ্দুস বয়াতি

‘বাংলাদেশে অনেক গুনী শিল্পী-সাহিত্যিক আছেন। এঁরা কদর পান না, মহব্বত পান না। অভাবগ্রস্থ শিল্পীরা বিনা চিকিৎসায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের যখন যৌবন থাকে, তখন সারাদেশ এমনকি পৃথিবী কাঁপিয়ে দিই। কিন্তু যখন শিল্পীরা বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েন, তখন তাদের আর কদর থাকেনা।’ চরম ক্ষোভ আর হতাশার সঙ্গে কথাগুলো বলেছেন লোকসংগীত শিল্পী আব্দুল কুদ্দুস বয়াতি।

সম্প্রতি পুঁজিবাজার বিট রিপোর্টারদের সংগঠন সিএমজেএফ’র উদ্যোগে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে নৌ-বিহার কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। তিনদিন ব্যাপি এ সফরের এক ফাঁকে তার মুখোমুখি হন রাইজিংবিডির নিজস্ব প্রতিবেদক নিয়াজ মাহমুদ। লোক সম্রাটখ্যাত এ সংগীত শিল্পী কথা বলেন তার জীবন সংগ্রাম ও দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। রাইজিংবিডি : দেশের প্রত্যান্ত অঞ্চল থেকে কীভাবে বিশ্বখ্যাতি সম্পন্ন শিল্পীর তালিকায় স্থান করে নিলেন?কুদ্দুস বয়াতি : ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনার কেন্দুয়ার এক নিভৃত পল্লীতে আমার জন্ম। ঘর-বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। তাই চলে আসি ঢাকায়। চালচুলোহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আর স্কুল কলেজেতো যেতেই পারিনি। মুখে মুখে গান গেয়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরতাম। এক অনিশ্চিত জীবনের সামনে দেখা মেলে অভিনেতা আফজাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি আমাকে তখনই তার বিদেশি সংস্থার ডকুমেন্ট তৈরীতে অভিনয়সহ চারণ সঙ্গীত ব্যবহারের আগ্রহ প্রকাশ করেন। যথারীতি সেটা করেও ফেলি। তখন দেশের মানুষ চিনতে পারে কুদ্দুস বয়াতি নামের এক ‘ব কলম’ চারণ লোকজ শিল্পীকে। এরপর শুধুই সামনে এগিয়ে চলা।রাইজিংবিডি : কত বছর বয়সে লোক সঙ্গীত শুরু করেন?কুদ্দুস বয়াতি : মাত্র ১১ বছর বয়স থেকেই বাবার হাত ধরে গান গাওয়া শুরু করি। রাইজিংবিডি : সঙ্গীত ভূবনে ঢোকার উদ্দেশ্য কী ছিল?কুদ্দুস বয়াতি : মনের আনন্দে গান করি। তবে একটা গভীর উদ্দেশ্য আছে। তা হচ্ছে, আমি ‘ব-কলাম।’ লেখা-পড়ার কোন সুযোগ পায়নি। তাই দেশের শিশু ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য সচেতনা সৃষ্টি করে যাচ্ছি। রাইজিংবিডি : সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাউল শিল্পীদের কি কোন পার্থক্য আছে?কুদ্দুস বয়াতি : বড় পার্থক্য আছে। আমরা আউলবাউলরা তো পাগল, আমরা গান ছাড়া কিছুই বুঝি না। জগত সংসারে কী হচ্ছে, তার খবর রাখি না। রাইজিংবিডি : আপনি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের খুবই কাছের মানুষ। তার সম্পর্কে কিছু বলেন।কুদ্দুস বয়াতি : হুমায়ূন স্যার ছিলেন দেশ গড়ার কারিগর, মানুষ গড়ার কারিগর।  আমার ওস্তাদ মরেননি। কোটি মানুষের হৃদয়ে তিনি বেঁচে আছেন, থাকবেন। কেউ তাকে ভুলতে পারবেন না। স্যার চলে গেছেন, আমার মনে হয়, আমি একটি অঙ্গ হারিয়েছি। তিনি আমাকে ২২ বছর আগলিয়ে রেখেছিলেন। রাইজিংবিডি : আপনার জীবনে তিনি কেন এত সম্মানীয় ?কুদ্দুস বয়াতি : স্যারের অসংখ্য গান গেয়েছি। অসংখ্য গান বেধেছি তার পাশে থেকে। তিনি কোনো কোনো গানকে ভালো বলেছেন। আবার কোনো কোনো গানকে আরো উন্নত করার পরামর্শ দিতেন। দেশ প্রেমিক এই মানুষটি আমাকে দেশ ও দশের কাজে গান গাওয়া এবং সে গানকে দেশ গড়ার কাজে লাগানোর অনেক পরামর্শ দিতেন। তাই তিনি আমার কাছে অনেক সম্মানীয় একজন ব্যক্তিত্ব। রাইজিংবিডি : বর্তমান সময়ে লোক সঙ্গীতের অবস্থা কী?কুদ্দুস বয়াতি : দেশ-বিদেশে বাংলা লোকগীতিকে জনপ্রিয় করে তুলেতে কাজ করে যাচ্ছি। আমার মতো হাজার হাজার শিল্পী তৈরি হচ্ছে। তারা আগলিয়ে ধরবেন লোকজ সঙ্গীতকে- এটাই আশা করি। কারণ রাজনৈতিক হানাহানিতে বাংলাদেশের সংস্কৃতি দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে।  

রাইজিংবিডি : লোক সঙ্গীত বিকাশে এবং শিল্পীদের সম্মানে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিৎ বলে আপনি মনে করেন?কুদ্দুস বয়াতি : আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে সরকারের অনেক ভূমিকা রয়েছে। নামি-দামি শিল্পীদের কোন জাতীয় পুরস্কার দেয়া হচ্ছে না। তারা রাজনৈতিক কারনে কোন সস্মান পাচ্ছেন না। বাংলাদেশে অনেক গুনী শিল্পী, সাহিত্যিক আছেন যারা কদর পান না, মহব্বত পান না। অভাবগ্রস্থ শিল্পীরা বিনা চিকিৎসায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন। আমাদের যখন যৌবন থাকে, তখন সারাদেশ এমনকি পৃথিবী কাঁপিয়ে দিই। কিন্তু যখন শিল্পীরা বয়সের ভারে ন্যুয়ে পড়েন তখন তাদের আর কদর থাকে না। রাইজিংবিডি : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?কুদ্দুস বয়াতি :  আউলবাউলদের উন্নয়নে কাজ করে যেতে চাই। আর এ জন্য ‘কুদ্দুস বায়াতি ফাউন্ডেশন’ গঠন করেছি। শুধু বাউলদের জন্য নয়, এর মাধ্যমে দেশের জন্যও কাজ করে যেতে চাই। রাইজিংবিডি : আপনাকে ধন্যবাদ।কুদ্দুস বয়াতি : ধন্যবাদ রাইজিংবিডিকেও।

 

রাইজিংবিডি / নিয়াজ / সন্তোষ