সাক্ষাৎকার

আগামীতে ভালো বই না করলে কেউ টিকতে পারবে না : মাহবুবুল হক 

ইকরিমিকরি। শিশুদের কাছে তো বটেই, শিশুসাহিত্য যাদের প্রিয়, তারাও নামটির সঙ্গে পরিচিত। ইকরিমিকরি যেন এক স্বপ্নরাজ্য। সে রাজ্যে আছে ছোট্ট এক বইয়ের কারখানা। সেখানে বই তৈরি হয় শুধু ছোটদের জন্য। রঙিন রঙিন তুলতুলে সব বই। শিশুদের বই তো আর যেনতেনভাবে করা যায় না। দরকার গভীর মমতা আর ভালোবাসা। এ রকম বই বানাতে দরকার মনের মতো গল্প আর দারুণ সব অলঙ্করণ। বই দেখে ভালো লাগলে তবেই না শিশুদের বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেবে। বন্ধুত্ব হবে বইয়ের সঙ্গে। আর ঠিকঠাকমতো ওদের বন্ধুত্বটা জমে গেলে তবেই ইকরিমিকরির আনন্দ। সেই আনন্দ বিলিয়ে দেওয়াই যার ধ্যানজ্ঞান তিনি মাহবুবুল হক। ইকরিমিকরির প্রকাশক তিনি। 

মুজাহিদ বিল্লাহ : সাতে পা রাখল ইকরিমিকরি। এই স্বপ্নযাত্রার সূচনা-দিনের কথাগুলো জানতে চাই। 

ইকরিমিকরি : আমরা শিশুদের সঙ্গে নিয়ে ওদের জন্য একটা কাজ করার চেষ্টা করছি। আমরা চাই শিশুদের শৈশব আনন্দময় হোক। সঙ্গে থাকুক বই, মাতৃভাষা যেহেতু বাংলা তাই বাংলা বই পড়াকে আনন্দময় করে তুলতে চাই। সেজন্য চাই বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য আরও আরও উপযোগী বই প্রকাশ করতে। বই দেখে আনন্দ পেলে তবেই সে বইটা পড়বে। দেখে ভালো না লাগলে বইটা তাকে টানবে না, সে তখন পড়তে চাইবে না। যখন আমরা প্রকাশনা শুরু করলাম, দেখলাম বাজারে কী কী বই আছে। দেখলাম ইলাস্ট্রেশন, বুক ডিজাইন, কনটেন্ট প্রত্যেকটা জায়গায় অনেক কাজ করা দরকার। একটি দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান না। সবাই মিলে করা দরকার। ইকরিমিকরি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয় ২০১২ সালে। ২০১৬ সালে শুরু হয় অফিসিয়ালভাবে। কয়কজন বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করেছিলাম। তিন বন্ধু অর্থ যোগান দিলেও অসংখ্য বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী আর মানুষের ভালোবাসায় নির্মিত ইকরিমিকরি। যাঁদের সকলের প্রতি আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ।

মুজাহিদ বিল্লাহ : কাজটি কঠিন নিঃসন্দেহে। চাইলে বড়দের বইয়ের প্রকাশক আপনি হতে পারতেন। কিন্তু এই কঠিন কাজটি আপনি বেছে নিলেন কেন?

ইকরিমিকরি : বলতে পারেন (হেসে) অন্যকিছু পারি না তাই। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড ফাইন আর্টস। ফাইন আর্টসে পড়ার সময় থেকে সংবাদপত্রের সাথে যুক্ত ছিলাম। গ্রাফিক্স এডিটর, ভিজ্যুয়াল এডিটর হিসেবে কাজ করেছি। ছোটখাটো প্রকাশনার কাজ করেছি। একটু ঘাটাঘাটিও করেছি, টুকটাক পড়ালেখা করে মনে হয়েছে চেষ্টা করলে পারবো। মনে হলো বাচ্চাদের জন্য আনন্দ নিয়ে কাজ করতে পারবো।

মুজাহিদ বিল্লাহ : আমরা প্রায়ই শুনি- বই মানুষ আগের মতো পড়ে না। শিশুদের ক্ষেত্রেও কি তাই? 

ইকরিমিকরি : ব্যক্তিকেন্দ্রীক জায়গা থেকে বললে এখনকার অভিভাবকদের কিন্তু শিশুদের বই পড়ানোর আগ্রহ আছে, বেড়েছে; যারা একটু সংস্কৃতিমনা পরিবার। তবে এই বৃদ্ধিটা অনেক বেশি হওয়া দরকার। পারিবারিকভাবে যাদের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় আছে তারা তো বই পড়ে কিন্তু এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বই পড়ার সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে গড়ে তুলতে হবে। এখন কিন্তু প্রচুর বই আসে দেশের বাইরে থেকে, বিশেষ করে বাচ্চাদের বই। এই বাজারটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে তুলনা করলে আমাদের বইয়ের গুণগত মান বহুগুণ উন্নত হওয়া উচিত। বইয়ের মার্কেট নিয়ে আমরা কি রিচার্স করেছি? শিশুদের বই নিয়ে ইনডেপথ গবেষণা তেমন হয়নি। সমিতি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, লেখক, শিল্পী সবারই আরো মন, মেধা দিয়ে সৃজনশীলতা দিয়ে কাজ করা উচিত। সম্পাদনা, রাইট শেয়ার, প্রযুক্তি, বাণিজ্য উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং গড়ে তোলা দরকার।

আমাদের দেশে খুব বেশি শিশুদের উপযোগী বই প্রকাশের চর্চা বেশি দিনের না। বাচ্চাদের জন্য আলাদাভাবে মনোযোগ দিয়ে বই প্রকাশ করতে হয়। বাইরের দেশে ৬ মাসের বা আরো ছোট বাচ্চার উপযোগী বইও প্রকাশ হয়। সে তো আসলে পড়তে পাওে না কিন্তু সে অক্ষর চেনার চেষ্টা করে। রং দেখে আনন্দ পায়। এসব নিয়ে আমাদের দেশে কাজ নেই। ইকরিমিকরি খুবই ছোট একটা সংগঠন। আমরা কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশে ২০১৬ সালের আগের শিশুদের বই আর পরের বই আলাদা করলে কিছু পার্থক্য দেখতে পারবেন। বইয়ের চেহারা, প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন, বুক ডিজাইন আমরা চেঞ্জ করেছি ব্যাপকভাবে। যা সবাই পছন্দ করেছে। অনেকে এডাপ্ট করেছে। বাচ্চাদের বয়স অনুযায়ী ধরে ধরে কাজ করার চেষ্টা করছি। এখন আরো অনেকেই করছে কাজটি। কিছুটা হলেও আমরা উন্নতির দিকে যাচ্ছি। প্রত্যেক বছর ১০০টা ৫০টা বই করার চেয়ে ৫টা বই ভালো করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বইটা যথাযথ উপযোগী না হলে ভালো ফল পাওয়া যায় না।

মুজাহিদ বিল্লাহ : আমাদের দেশে শিশুসাহিত্য খুব অবহেলা নিয়ে ছাপা হয়। প্রকাশক হিসেবে এর সাথে আপনি কি একমত?

ইকরিমিকরি : হ্যাঁ, একমত। আমাদের দেশে সাধারণত বেশিরভাগ কাজই অবহেলা নিয়ে করা হয়। সব সেক্টরেই। কেন যেন মোরাল জায়গায় আমাদের একটা ঘাটতি আছে মনে হয়, আসলে প্রফেশনালিজমটা তৈরি হয়নি। প্রকাশক তো এই সমাজের বাইরে না। আসলে, প্রত্যেকটা জায়গাতেই অনেক কাজ করা দরকার। অনেক অনেক। যেসব প্রতিষ্ঠান এই ইন্ডাস্ট্রির সেন্টারে আছে তারা যদি ঠিকভাবে কাজ না করে তাহলে হবে না। আমাদের কিন্তু দুইটা তিনটা সমিতি আছে। আরও ছোট ছোট অর্গানাইজেশন আছে। কিন্তু আমরা আসলে কি করছি? আমরা যদি ঠিকঠাক কাজ করতাম তাহলে সেক্টরটা এরকম থাকতো না। আমি অনেকগুলো ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফলো করি। তাদের অনেকের সঙ্গে কানেক্টেড। আমার মনে হয় যে, আমাদের অর্গানাইজেশনগুলো আসলে কি করছে?

আমি হতাশ নই। আমার মনে হয় একদিন হয়তো ভালো কিছুর যাত্রা শুরু হবে। আমরা শিখব। আমাদের বাচ্চাদের বইয়ের মার্কেটটা আরও বড় হবে আগামী ৫ বছরে। আগামীতে ভালো বই না করলে কেউ টিকতে পারবে না। কারণ সবাই ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছে। ১০০ বাচ্চাকেও যদি আমরা বিন্দুমাত্র সাপোর্ট দিতে পারি তাহলেও খুশি হবো, ভাববো যে কিছু করতে পেরেছি। আমরা বছরে শত শত বই করতে চাই না, ঠিকঠাক মতো অল্প বই করতে চাই। ইকরিমিকরির বই নিয়ে আমি যে খুব সন্তুষ্ট তা না। হয়তো আরো ভালো করা যায়। আরো ভালো করা যেত। আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের প্রকাশিত বইয়ের মধ্যেও আমার পছন্দের বই অনেক কম। আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। শিখতে হবে, শেখাতে হবে। এটি যেহেতু দলগত কাজ আপনি একা করতে পারবেন না। ধরেন, আপনি যে পরিকল্পনা করবেন আপনার সম্পাদককে সেটা ফলো করতে হবে, লেখককে  সেটা ফলো করতে হবে, অলঙ্করণশিল্পীকে ফলো করতে হবে, প্রডাকশনকেও সর্বোচ্চটা দিতে হবে। তাহলেই সম্ভব। সবার কমিটমেন্ট ঠিক রাখতে হবে।

মুজাহিদ বিল্লাহ : শিশুতোষ বইয়ের অলঙ্করণশিল্পী বা প্রচ্ছদশিল্পীদের নিয়েও কিছু ধারণা আছে। অনেকের অভিযোগ তারা যত্ন নিয়ে কাজ করেন না। 

ইকরিমিকরি : হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। তবে সবাই এক না। এখানে আমি শুধু শিল্পীদের আলাদা করে দেখি না। আগেই যেটা বলেছি, আমরা তো আসলে মোরাল জায়গায় ঠিক নেই। কমিটমেন্ট ঠিক নেই। তাই শুধু তাকে আমি দোষ দেই না। প্রফেশনালিজম তৈরি হলে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। ইকরিমিকরি থেকে যারা বই প্রকাশ করেছেন তারা জানেন আমরা একটা অন্য ওয়েতে বই প্রকাশ করি। লেখক শিল্পী প্রকাশক, মূলত এই তিনজন মিলে যৌথভাবে কাজ করতে হয়, ফুল টিম তো থাকেই। বাচ্চাদের বইয়ে ভিজুয়াল কনটেন্ট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় লেখার চেয়েও বেশি। অনেক লেখক এটা মানতে চান না। তাই ইচ্ছা থাকলেও তাদের বই হয়তো করা হয় না। আমরা কারো ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য বই প্রকাশ করি না। ইকরিমিকরি থেকে বই প্রকাশ করতে চাইলে প্রক্রিয়া মেনেই করতে হবে।

মুজাহিদ বিল্লাহ : আমাদের দেশে অনেক প্রকাশক আছেন যারা সম্পাদনা ছাড়া, কোনো বুক প্ল্যানিং না করেই বই প্রকাশ করছেন। এটা কেন হচ্ছে? 

ইকরিমিকরি : আমাদের দেশে আসলে প্রফেশনালিজমটা গড়ে ওঠেনি। বই ছাপা আর বই প্রকাশ করা এক বিষয় না। যিনি বই প্রকাশ করেন তিনি তা করেন পরিকল্পনা থেকে। একটা পা-ুলিপি পেয়ে কম্পোজ করে লেখকের শখ অনুযায়ী একটা প্রচ্ছদে বই ছেপে ফেলাকে প্রকাশনা বলা যায় না। এটা ছাপাখানাই করতে পারে। প্রকাশককে তার লক্ষ্য ঠিক রেখে লেখা ও লেখক নির্বাচন করতে হবে, বাজার বুঝতে হবে, সম্পাদনা ছাড়া বই প্রকাশ হওয়া উচিত না। আরেকটা ব্যাপার হলো বড়দের সাহিত্য আর ছোটদের সাহিত্যের মূল পার্থক্য বুঝতে হবে। পার্থক্যটা মূলত উপযোগিতার।

মুজাহিদ বিল্লাহ : প্রকাশক হিসেবে নবীন লেখকদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?

ইকরিমিকরি : প্রথমত শিশুদের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে, রঙিন একটা মানসিকতা থাকতে হবে, মানবিক মন থাকতে হবে, মানসিক জায়গা থেকে সরল থাকতে হবে। পড়তে হবে, দেখতে হবে, জানতে হবে। দেখাটা খুব দরকারি। আমি যত দেখতে পারবো ততো জানতে পারবো তত সুন্দর ডেলিভারি দিতে পারবো। আর টেকনিক্যাল বিষয়গুলো যেমন বানান, কনটেন্টের ধরন ইত্যাদি বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে বা কর্মশালা থেক শিখে নিলে ভালো হয়।