সাক্ষাৎকার

‘দেশের মাংসের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় ভারত থেকে’

দিন দিন বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের দাম। বলা হয়ে থাকে- মাংস এখন নিম্নবিত্তের সাধ্যের বাইরে। ২০১৬ সালে গরুর মাংসের দাম ছিল ৩২০ টাকা কেজি। এখন সেটি প্রায় ৮০০ টাকা কেজি। দফায় দফায় গরুর মাংসের দাম বাড়লেও, কি কারণে দাম বাড়ছে জানেন না সাধারণ ক্রেতা। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করছেন মূল্য। এ প্রসঙ্গে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম। 

রাইজিংবিডি: দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাংসের দাম। এমন কেন হচ্ছে? 

রবিউল আলম: মাংসের দাম এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা সম্পূর্ণ ভারত নিয়ন্ত্রণ করে। এই সিন্ডিকেট বর্ডারের ওপারে বসেই এখানে নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ফ্রি স্টাইলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কেন হয়েছে আমি নিজেও জানি না। ৪৫ বছর আমরা মাংসের মূল্য নির্ধারণ করেছি। ২০১৬ সালে আমাদের মাংসের দাম ছিল ৩২০ টাকা। বাড়লেও ৫-১০ টাকা আমরা সমন্বয় করে নিতাম। এরপর ভারতীয় গরু যখন পাচার করা শুরু হলো তখন পাচারকারীরা সীমান্ত পার করার জন্য গরুপ্রতি পাঁচ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া শুরু করলো। ভারতে যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক, এর হেরফের হয় না। আমরা সরকারের কাছে চোরাই গরু বন্ধের আবেদন করলাম। গরু আনা বন্ধ হলো কিন্তু চোরাই পথ খোলাই রইল। উল্টো বিকল্প হিসেবে মাংস আমদানি শুরু হলো। এখন প্রশ্ন হলো- এই যে আমরা মাংস আমদানি করি, কত টাকায় আমদানি করি আর কত টাকায় বিক্রি করি এর তদারকি কেউ করে না। দীর্ঘদিন ফ্রিজে রাখা সেই মাংস কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত সে খবরও আমরা রাখি না। 

রাইজিংবিডি: মূল সমস্যা কোথায় বলে আপনার মনে হয়?  

রবিউল আলম: দেখুন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কোনো জবাইখানা নাই। কোনো ভেটেরিনারি সার্ভিস নাই। খাদ্য নিরাপত্তার কথা তোলা হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য আমরা কোত্থেকে দেব! অথচ সিটি কর্পোরেশন কিন্তু ঠিকই ট্যাক্স নিচ্ছে। আবার তারা বলছে- বেশি দামে বিক্রি করলে এটা করবো, ওটা করবো। কিন্তু কত দামে বিক্রি করবো নির্দিষ্ট করে কিছু বলছে না। তারা মূল্য কেন নির্ধারণ করে না? তেলের মূল্য নির্ধারণ হয়, চিনির হয়, চাল-ডালের হয়, শুধু মাংসের মূল্য নির্ধারণ হয় না। মাংস ফ্রি স্টাইলে চলছে- এর কারণ কি? ভারতীয় ব্যবসায়ীদের হাতে আমাদের মাংসের বাজার তুলে দেয়ার জন্য? এটা আমার প্রশ্ন।

রাইজিংবিডি: সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যেতে পারে?  

রবিউল আলম: দেশে এত চর; একটা চরে কি পশু প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেত না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প করলেন। দারুণ ব্যাপার! সেখানে যদি আমরা দুটো গরুর বাচ্চা দিতাম তারা কি গরুগুলো পালতো না? আমরা এক কোটি পরিবারকে আশ্রয় দিচ্ছি। দুই কোটি পরিবারকে স্বল্পমূল্যে খাবার দিচ্ছি। যদি ৫০ লাখ পরিবারকে পশুপালনের আওতায় আনতে পারতাম তাহলে এই সমস্যা অনেকটাই দূর হতো।  আরেকটা বিষয় বলি- বাংলাদেশের আবহাওয়া, কৃষক, স্বাদু পানি কিন্তু শ্রেষ্ঠ। আমরা কিন্তু এটাকে কাজে লাগাতে পারছি না। বিভিন্ন জিনিসের রপ্তানির লিমিট থাকে কিন্তু মাংসের ক্ষেত্রে লিমিট নেই। অথচ এই সুযোগও আমরা নিতে পারছি না। 

রাইজিংবিডি: প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। 

রবিউল আলম: প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় যদি মাংসের দাম কেজিপ্রতি ৬৫০ টাকা ধরে বিক্রি করে তাও প্রায় আড়াই কোটি টাকা ডেমারেজ দিতে হয়। এতে কি মাংসের বাজার নিয়ন্ত্রিত হবে? তারা যদি ৬৫০ টাকা করে বিক্রি করে তাহলে সাধারণ মানুষ তো হাটেবাজারে ৭৫০ টাকা বিক্রি করবেই। 

রাইজিংবিডি: দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আপনারা কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কিনা? 

রবিউল আলম: আমাদের কাছে তো আলাদীনের যাদুর চেরাগ নাই। সিটি কর্পোরেশন আমাদের একটা সুবিধা দিতো- খাজনা। এখন আমাদের সমিতির অফিসটাও তারা দখল করেছে। কর্পোরেশনের সহায়তায় গাবতলি হাটের ইজারাদাররা অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার নির্ধারিত যে ১০০ টাকা খাজনা ছিল সেটাও তারা বন্ধ করে দিয়ে টাকা লুটে নিচ্ছে। আমাদের টাকাগুলো তারা পকেট কেটে নিচ্ছে। আমরা কাস্টমারের গলা কেটে সেটা আদায় করছি।

এখন যেহেতু ভোক্তা অধিকার বলছে- আপনারা সাইনবোর্ড লাগিয়ে মাংস বিক্রি করেন। কত টাকা বিক্রি করবেন এটা আপনাদের ইচ্ছা। এখন ফ্রি স্টাইলে ব্যবসায়ীকে ছেড়ে দিলে আসলে লাভ হবে না। কারণ  সব ব্যবসায়ী ভালো লোক নন। আমার কথা মাংসের কেন মূল্য নির্ধারণ করা যাবে না? কেন মাংসের বাজার মুক্ত অর্থনীতির কথা বলে মুক্ত করে দেয়া হলো? মুক্ত বাজার অর্থনীতির মানে কি জাতির পকেট কাটা? আমাদের ৭৫% দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেকেই পেশা বদল করে ফেলছে। অনেকে যুদ্ধ করে টিকে আছে।