তরুণদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন লামিয়া তাসনীম। তার নতুন উদ্যোগ ‘ব্রেইন ওয়েভস’। ‘ব্রেইন ওয়েভস’ বাংলাদেশের ২৬টি জেলার ৫০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রাথমিক পরামর্শদাতা হিসেবে। এছাড়া লামিয়া তাসনীম ‘লেটস টক মেন্টাল হেলথ’ সংস্থার জেনারেল সেক্রেটারি। তিনি কমওয়েলথ ইয়ুথ কাউন্সিলের লাইফটাইম এক্সিকিউটিভ মেম্বার এবং সার্ক ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য। মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নসহ তরুণদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে রাইজিংবিডি ডটকমের সাথে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ।
রাইজিংবিডি: মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় কাজ করার আগ্রহ কীভাবে পেলেন? লামিয়া তাসনীম: আমার মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় আগ্রহের শুরু এক গভীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি তখন আমার প্রিয় বান্ধবী-আমার খেলার সাথী আত্মহত্যা করেছিল। সেই সময় ঐ বয়সে আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি যে-কেন কেউ এত কষ্টের মধ্যেও সাহায্য চায়নি বা তার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনি। সেই ঘটনা আমাকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল।তখনই আমি ঠিক করলাম মানুষ যেন মানসিক সমস্যার কথা লুকিয়ে না রাখে, সাহস করে সাহায্য চাইতে পারে এই লক্ষ্যে কাজ করব। এই হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা থেকেই আমি ‘লেটস টক মেন্টাল হেলথ’-এর সাথে যুক্ত হয়েছি।
রাইজিংবিডি: মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই? লামিয়া তাসনীম: মানসিক স্বাস্থ্যসেবা-এটি একটি সহজ কিন্তু অনস্বীকার্য সত্য। মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়া কোনো স্বাস্থ্য নেই। আমাদের মন এবং শরীর একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ভালো না থাকলে অন্যটিও ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।”
রাইজিংবিডি: ‘লেটস টক মেন্টাল হেলথ’ এবং ‘ব্রেইন ওয়েভস’ কী কী কাজ করছে? লামিয়া তাসনীম: ‘লেটস টক মেন্টাল হেলথ’ মূলত মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্টিগমা কমানোর কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কমিউনিটিতে সেশন পরিচালনা করি, যা প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষকে সরাসরি উপকৃত করেছে।
‘ব্রেইন ওয়েভস’ প্রজেক্টের মাধ্যমে আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, যাতে তারা ছাত্রদের মানসিক মেন্টাল হেলথ ফার্স্ট এইড দিতে পারে। প্রশিক্ষণের ফলে শিক্ষকরা বুঝতে পারে, কখন সমস্যা গুরুতর হয় এবং কখন পেশাদার মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক শিক্ষক প্রশিক্ষিত হয়েছেন, যার মাধ্যমে প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী মানসিক সহায়তা পাচ্ছে।
রাইজিংবিডি: শুধু শিক্ষক নয়, অন্য বয়সীদের মধ্যেও কাজ করছেন? লামিয়া তাসনীম: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা শুধু শিক্ষকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তরুণ, কলেজ-বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, প্যারেন্টস এবং কমিউনিটি লিডারদের মধ্যেও সচেতনতা ছড়াই। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক একটি কমিউনিটি ওয়ার্কশপে দেড়শ তরুণ অংশগ্রহণ করেছিলেন, এবং দেখা গেছে তাদের মধ্যে ৭২ শতাংশ পরিবার ও বন্ধুদের সচেতন করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে কাজের প্রভাব শুধু শিক্ষার্থীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, পুরো কমিউনিটিতেও ছড়িয়েছে।
রাইজিংবিডি: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার চ্যালেঞ্জ কী কী? লামিয়া তাসনীম: আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য এখনও স্টিগমার মধ্যে রয়েছে। অনেকেই সমস্যার কথা লুকিয়ে রাখে বা সাহায্য নেওয়ার আগে দ্বিধা করে। এছাড়া পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত মানুষ ও সংস্থার অভাবও বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য মাত্র ০.৫ জন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে। তাই, সচেতনতা ছড়ানো এবং দক্ষ, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা এক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাইজিংবিডি: কাজ করতে গিয়ে অভিজ্ঞতা কেমন? লামিয়া তাসনীম: অত্যন্ত আনন্দদায়ক। তবে কখনও কখনও হৃদয়বিদারকও। বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বললে, আমাদের ‘ব্রেইন ওয়েভস’ প্রজেক্টের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা কয়েক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার চেষ্টা থামাতে সক্ষম হয়েছেন।এছাড়া, তরুণরা এখন তাদের সমস্যা প্রকাশ করতে এবং পেশাদার সাহায্য নিতে সাহস পাচ্ছে। এমন অভিজ্ঞতা আমাকে আরো উদ্দীপ্ত করে এবং মনে করিয়ে দেয়, কেন এই মেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করাটা অপরিহার্য।
রাইজিংবিডি: সম্প্রতি নেপালে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০২৫-এ মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং তরুণ নেতৃত্বে বিশেষ অবদানের জন্য সম্মানিত হয়েছেন। কেমন লাগছে? লামিয়া তাসনীম: এটি আমার জন্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক এবং গর্বের। এটি শুধু আমার নয়, পুরো ‘লেটস টক মেন্টাল হেলথ' দলের স্বীকৃতি। বিশেষ করে, এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে তরুণ নেতৃত্ব মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই সম্মান আমাকে আরো বড় দায়িত্বের দিকে একধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
রাইজিংবিডি: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? লামিয়া তাসনীম: আমি চাই মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে পরিচিত করতে। আগামী ৫ বছরে, বাংলাদেশের অন্তত ১০টি জেলায় স্থায়ী মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রোগ্রাম চালু করার এবং ৫০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে সরাসরি মানসিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি, আরো বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই এই মুহূর্তে আমার লক্ষ্য।