আইন ও অপরাধ

দুই চিকিৎসকে ঝুলে আছে হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক : দীর্ঘ ১৩ বছরেও শেষ হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার বিচার। সাক্ষ্য দিতে দুই চিকিৎসককে পুলিশ আদালতে হাজির করতে না পারায় মামলাটির বিচার ঝুলে আছে। ২০০৪ সালের এই দিনে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে মারাত্মক আহত হন হুমায়ুন আজাদ। সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলার অধিকাংশ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। কিন্তু মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুই চিকিৎসক সাক্ষ্য না দেওয়ায় মামলাটির বিচার শেষ করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জাহিদুল কবিরের আদালতে বিচারাধীন। মামলাটিতে ৫৮ সাক্ষীর মধ্যে ৩৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৭ এপ্রিল ওই দুই চিকিৎসকের সাক্ষ্য দেওয়ার দিন ধার্য রয়েছে। যে দুই চিকিৎসকের কারণে মামলাটির বিচার শেষ করা যাচ্ছে না তারা হলেন শহিদুল ইসলাম ও মেজর শওকত হাসান। ডা. শহিদুল ইসলাম ঘটনার সময় সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। আর ডা. শওকত হাসান সার্জিক্যাল বিশেষজ্ঞ হিসেবে সেই সময় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) কর্মরত ছিলেন। তারা দুজনই হুমায়ুন আজাদের শরীরের জখমের পরীক্ষা করেন। তাদের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে সমন পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তারা আদালতে এসে সাক্ষ্য না দেওয়ায় মামলার বিচার শেষ হচ্ছে না। জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরও তাদের সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর এ পর্যন্ত কয়েকটি ধার্য তারিখ অতিবাহিত হলেও তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হননি। গত ২ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানা-পুলিশ ও ২৯ জানুয়ারি ক্যান্টনমেন্ট থানা-পুলিশ ওই দুই চিকিৎসক বর্তমানে কর্মরত নেই বলে প্রতিবেদন দিয়ে আদালতকে জানায়। তবে ওই প্রতিবেদনে স্থায়ী ঠিকানায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে কি না তা উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, ‘মামলাটিতে তদন্ত কর্মকর্তাসহ অধিকাংশ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়ে গেছে।  মামলায় দুই চিকিৎসক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। তাদের অবশ্যই সাক্ষ্য দিতে হবে। পুলিশ বলছে, অফিশিয়াল ঠিকানায় তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তারা গ্রামের ঠিকানা (স্থায়ী ঠিকানা) বের করে খোঁজ করছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতিতেই এ মামলার বিচারকাজ আটকে আছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো অবহেলা নেই।’ ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাদের সাক্ষ্য দিতে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি। মামলা সম্পর্কে ওই আদালতের অ্যাডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম বলেন, মামলার কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে। দুই চিকিৎসকের সাক্ষ্য গ্রহণ করে সাক্ষী ক্লোজ করা হবে। কিন্তু পুলিশ ওই দুই সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পুলিশের যথেষ্ট গাফিলতি রয়েছে।’ মামলার বিচার কবে শেষ হতে পারে এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আশা করেছিলাম মামলাটির বিচার ২০১৫ সালেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু পুলিশ সাক্ষী হাজির করতে না পারায় সেটা সম্ভব হয়নি। তবে আশা করছি শিগগিরই আলোচিত মামলাটির বিচার শেষ হয়ে যাবে।’ ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে বাংলা একাডেমির উল্টোদিকে ফুটপাতে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে মারাত্মক আহত হন হুমায়ুন আজাদ। হামলার পর তিনি ২২ দিন ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কয়েক মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০০৪ সালের আগস্টে গবেষণার জন্য জার্মানিতে যান এই লেখক। পরে ওই বছরের ১২ আগস্ট মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাটে তার মৃত্যু হয়। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার পরদিন তার ছোট ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। পরে আদালতের আদেশে অধিকতর তদন্তের পর সেই মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মঞ্জুর কবির বলেন, ঘটনার ১৩ বছর পার হলেও এখনো এর বিচার শেষ হয়নি। দীর্ঘদিনে সব সয়ে গেছে। এখন আর কিছুই বলার নেই। সরকার এ মামলাটি ডিপ ফ্রিজে দিয়ে রেখেছে। হুমায়ুন আজাদের ওপর চরমপন্থি ইসলামি জঙ্গিরা এই হামলা চালিয়েছিল বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল পাঁচ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। প্রথমে এটি হত্যাচেষ্টা মামলা হলেও সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের মধ্য দিয়ে এটি হত্যা মামলায় পরিণত হয়। হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়াজে বিষোদগার করা জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রথমে মামলাটিতে আসামি করা হলেও পরে তাকে বাদ দেওয়া হয়। মামলার আসামিরা হলেন জেএমবির শুরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন, হাফিজ মাহমুদ ও নূর মোহাম্মদ ওরফে সাবু। আসামিদের মধ্যে মিনহাজ ও আনোয়ার কারাগারে রয়েছে। সালাহউদ্দিন ও নুর মোহাম্মদ পলাতক রয়েছেন। আর হাফিজ মারা গেছেন। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রিজন ভ্যান থেকে এ মামলার দুই আসামি সালাহউদ্দিন ও রাকিবুল হাসানকে ছিনিয়ে নেয় সন্ত্রাসীরা। পরে এদের মধ্যে রাকিব ওই দিন রাতেই ধরা পড়েন এবং পরে ক্রসফায়ারে নিহত হন। এ মামলার উল্লেখ্যযোগ্য সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে রয়েছেন হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির, আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন এলএলবি অনার্সের ছাত্র এস এম শফিকুর রহমান আশিক, হুমায়ুন আজাদের স্ত্রী লতিফা, কবি মোহন রায়হান ও কবি সাংবাদিক নাসির আহমেদ।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/মামুন খান/এসএন/এএন