আইন ও অপরাধ

রাজধানীতে বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে দুদকের হানা

এম এ রহমান মাসুম : এবার বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারের মালিকদের সম্পদের খোঁজে রাজধানীর ফার্মগেট, পান্থপথ ও  কলাবাগান এলাকায় অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানের অংশ হিসেবে দুদকের দুটি বিশেষ দল বুধবার উদ্ভাস, কনফিডেন্ট ও রেটিনা, ইউসিসি, সাইফুর’স ও ম্যাবসের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে হানা দেয়। অবৈধ বাণিজ্যিক কোচিং, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া পরীক্ষার্থী সরবরাহ ও মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মসহ নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের এ অভিযান। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য রাইজিংবিডিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বুধবার বিকেলে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোর্শেদ আলমের নেতৃত্বে একটি দল এবং দুদকের সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে অপর একটি দল অভিযান চালায়। অভিযানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যারা কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত তাদের সম্পদ ও ব্যবসার বিষয়ে বিভিন্ন আভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আজ এ অভিযান চালানো হয়। মূলত আজ দুদকের দুটি বিশেষ দল এ অভিযান চালায়। ফার্মগেট, পান্থপথ ও কলাবাগান এলাকায় দুদকের সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে একটি দল ইউসিসি, সাইফুর’স ও ম্যাবসের বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে অভিযান চালিয়েছে। তারা আরো বলেন, দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোর্শেদ আলমের নেতৃত্বে অপর দল ফার্মগেট এলাকার উদ্ভাস, কনফিডেন্স ও রেটিনা কোচিং সেন্টারের ভবনে অভিযান চালায়। অভিযানের এ পর্যায়ে দুদক অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করে। তবে অভিযানে অধিকাংশ কোচিং সেন্টার বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, অবৈধ সম্পদের হিসাব চাইলে কোচিং সেন্টারগুলো যুক্তিযুক্ত হিসাব দিতে ব্যর্থ হবে। দুদকের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। সম্প্রতি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা ১১০টি কোচিং সেন্টারের তালিকা সামনে রেখে অনুসন্ধান শুরু করে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়। ভর্তি বাণিজ্য এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কোচিং বন্ধে বিশেষ অভিযানের পর এবার কোচিং সেন্টারের বিরেুদ্ধে দুদকের অভিযান শুরু হলো। দুদক সূত্র জানায়, ১১০ সেন্টারের বিরুদ্ধে অবৈধ কোচিং, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া পরীক্ষার্থী সরবরাহ, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। কোচিং সেন্টার মালিকরা কীভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, তাদের নামে কীভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ থাকতে পারে- এসবই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনুসন্ধান করা হবে। দুদক আরো জানায়, সারা দেশের কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে সিংহভাগই গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগর এলাকায়। যৌথ মালিকানাধীন কোচিং সেন্টারগুলো রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নিয়ে ও একক মালিকানাধীন সেন্টারগুলো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে অবাধে ব্যবসা করছে। এর মধ্যে সরাসরি কোচিং ব্যবসার কথা উল্লেখ করে আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েছে ১৯টি কোচিং সেন্টার। এই তালিকায় প্যাসিফিক, ভার্সিটি, বীকন, সানরাইজ, ক্ল্যাসিক, মেডিক্যাল, আইকনসহ অন্যান্য কোচিং সেন্টারের নাম রয়েছে। আরো ৩১৭টি প্রতিষ্ঠান তাদের নিবন্ধন সংক্রান্ত কাগজপত্রে নানাভাবে কোচিং শব্দ উল্লেখ করেছে। তাদের মধ্যে কোন কোন প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কোচিং করাবে তা নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি। দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, সারা দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। অভিভাবকদের পকেট থেকে যাচ্ছে এই টাকা। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে কোচিং সেন্টারগুলো। শুধু শহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। রাজধানীকেন্দ্রিক সেন্টারগুলো ঢাকার বাইরে একের পর এক শাখা খুলছে। খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বনামধন্য শিক্ষকরাও ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের বাসা-বাড়িতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ব্যাচে বাণিজ্যিকভাবে কোচিং করাচ্ছেন। অভিযোগে আরো বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা করে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করলেও এসব প্রতিষ্ঠান আরজেএসসি ও সিটি করপোরেশন থেকে নিবন্ধন নিয়ে অবাধে কোচিং ব্যবসা করছে। অভিযুক্ত ১১০টি কোচিং সেন্টারের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ৩৩টি, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ১৫টি, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পাঁচটি, মেরিন, টেক্সটাইল, ক্যাডেটের জন্য ছয়টি, একাডেমিক কোচিং সেন্টার ১৮টি, বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির জন্য ১৪টি ও ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষা শেখার ১৯টি কোচিং সেন্টারের নাম রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো কোচিং সেন্টার একাধিক খাতে কোচিং করাচ্ছে। খাত ভিত্তিক হিসেবে ১১০টির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ইউসিসি, ইউনিএইড (কিরণ, কবির, সুমন), ইউনিএইড (মনির, মল্লিক, জহির), ফোকাস, সানরাইজ, গার্ডিয়ান, ডিভাইন, এইউসিসি (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়), সাইফুর’স, ইপিপি (শুধু ক-ইউনিট), ডিইউসিসি, ডি-হক স্যার, লিডস, হোপ, আইকন প্লাস, ভয়েজ, মেরিন, আইকন, কোয়ান্টা, দুর্বার, প্যারাগন, অ্যাডমিশন এইড, প্রাইমেট, প্লাজমা, এইউএপি, সংশপ্তক, এফ্লিক্স, এডমিশন প্লাস, এডমিয়ার, ইউএসি, ইউরেনাস, পিএসি ও ইঞ্জিনিয়ার্স কোচিং সেন্টারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তির উদ্ভাস, রেটিনা, সানরাইজ, পিএসি, কর্ণিয়া, ডিএমসি, মেডিকো, দি রয়াল, গ্রীন অ্যাডমিশন এইড, থ্রি ডক্টরস, ফেইম, প্রাইমেট, প্লাজমা, এভিস ও মেডিকেয়ারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উদ্ভাস, সানরাইজ, পিএসি, ওমেকা ও মেরিনাথের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মেরিন-টেক্সটাইল-ক্যাডেটে ভর্তির জন্য ইম্যাক, ভয়েজ, মিরপুর ক্যাডেট কোচিং (ফার্মগেট শাখা), মেরিন গাইড, অ্যাডমিয়ার ও বর্ণ কোচিং সেন্টারের নাম রয়েছে। একাডেমিক কোচিং সেন্টার হিসেবে সানরাইজ, ডিভাইন, উদ্ভাস, ম্যাবস, অপরাজিতা, আইডিয়াল একাডেমি, রিয়াল, সেন্ট তেরেসা, অন্বেষা, ফেইম মবিডিক, ক্রিয়েটিভ, উদ্দীপন, ই-হক, বিইউপি, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড, দুরন্ত, অভিযাত্রিকের নাম রয়েছে। বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির জন্য কনফিডেন্স, বীকন, ওরাকল, ক্যারিয়ার এইড, এইউএপি, সাকসেস, সুগন্ধা, হোপ, প্রাইম একাডেমি, বিসিএস আপগ্রেড, ওয়ান ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, ইউনিট, গ্লোবাল প্রফেশনাল একাডেমি ও ডিফেন্স গাইড কোচিং সেন্টারের নাম উল্লেখ করা হয়। ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষা শেখার সাইফুর'স, এফএম মেথড, ইংলিশ ওয়ার্ড, ব্রিজ কাউন্সিল, সুগন্ধা, হোপ, টার্গেট, নজরুল, ওয়ান ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, হিলস, এজিসিসিসি, ওরি, গ্লোবাল, লিডার, ইংলিশ সেন্টার, এলফিক্স, বিজয়, সিডি মিডিয়া ও লিবার্টি ইংলিশ কোচিং সেন্টারের নাম রয়েছে। অনুসন্ধান কার্যক্রম তদারক করছেন দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ার। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ নভেম্বর ২০১৭/এম এ রহমান/রফিক