নিজস্ব প্রতিবেদক : সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিভক্ত আদেশে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। কিন্তু সংবিধানে ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ থাকায় জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে স্বাধীনভাবে মতামত দেওয়ার সুযোগ নেই। দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ থাকার কারণে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন নন। তারা নিজ দলের কাছে পরাধীন। দল যা বলবে তাই করতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সকল ক্ষমতার অধিকারী রাজনৈতিক দল, জনগণ নয়। আদেশে বলা হয়, শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ইউকেসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ওইসব দেশে আইন প্রণেতারা স্বাধীনভাবে মতামত দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে আমার অভিমত হলো, ওইসব দেশে ৭০ অনুচ্ছেদের মতো কোনো অনুচ্ছেদ নেই। ওইসব দেশের আইন প্রণেতাদের সঙ্গে আমাদের সংসদ সদস্যদের মৌলিক পার্থক্য নেই। আমাদের দেশে দলীয় হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ নেই। জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আরো বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলায় এই আদালত (হাইকোর্ট) ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে নিয়ে যে অভিমত দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, আপিল বিভাগের দেওয়া রায় আমাদের (হাইকোর্ট) জন্য মানা বাধ্যতামূলক। এ রিট আবেদনে রুল জারির মতো প্রাথমিক উপাদান রয়েছে। এ কারণে রুল জারি করা হলো। কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়ে আদেশে বলেন, ষোড়শ সংশোধনী মামলায় ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্ট যে অভিমত দিয়েছে তা আপিল বিভাগ গ্রহণ করেছেন ঠিক। তবে ষোড়শ সংশোধনী মামলা ছিল বিচার বিভাগ সংক্রান্ত। সেখানে বিচারক অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রসঙ্গ ছিল। সেখানে ৭০ অনুচ্ছেদ বিচার্য ছিল না। এ বিচারপতি বলেন, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়। সে সময় যেভাবে ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে, আজ পর্যন্ত সেভাবেই রয়েছে। এ অনুচ্ছেদের যৌক্তিকতা নিয়ে অতীতে কোনো সরকার বা সংসদে প্রশ্ন ওঠেনি। জনগণও প্রশ্ন তোলেনি। ৭০ অনুচ্ছেদের অপব্যবহার হয়েছে এমন নজিরও আমাদের সামনে নেই। আদেশে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, আদালত সংবিধান বা আইন প্রণয়ন করে না। শুধুই বলতে পারে, সংসদে প্রণীত আইন সংবিধান পরিপন্থী কিনা। এ কারণেইতো সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল বলে রায় দিয়েছেন। আদেশে বলা হয়, রিট আবেদনকারী তার আবেদনে বলেননি যে, ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানের আর কোন কোন অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এও বলেননি যে, আইন প্রণেতা কর্তৃক প্রণীত আইন বাতিল করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জনগণ সকল ক্ষমতার অধিকারী। আর সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি। তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আইন প্রণয়নে আদালত বাধ্য করতে পারে না। কার্যত সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্যই আদালতের সৃষ্টি। আদালতের দায়িত্ব সেটাই। বিচার বিভাগকে তার নিজস্ব সীমা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। আইন প্রণেতারা কী উদ্দেশ্যে আইন করছেন তা নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলতে পারে না। প্রসঙ্গত, আজ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না’ এই মর্মে রুল দিয়েছেন। তবে জুনিয়র বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন। নিয়মানুযায়ী এখন প্রধান বিচারপতি রিটটি নিষ্পতির জন্য তৃতীয় বেঞ্চ গঠন করে দেবেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জানুয়ারি ২০১৮/মেহেদী/মুশফিক