আইন ও অপরাধ

রাজধানীতে বেড়েছে ছিনতাই, আতঙ্কে নগরবাসী

আসাদ আল মাহমুদ : রাজধানীতে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ছিনতাই প্রবণতা। নতুন বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও বাসাবাড়িতে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বা সিসিটিভি বসানো হয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাবের প্যাট্রোল ডিউটি এবং সাদা পোশাকে ডিউটির পাশাপাশি ছদ্মবেশেও নজরদারি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাইকারীরা ছুরিকাঘাত কিংবা গুলি করে টাকাপয়সা কেড়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের।সব মিলিয়ে এক ধরনের আতঙ্কে আছে নগরবাসী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করতে যান না বা অভিযোগ করেন না। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ছিনতাইকারীদের ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ছিনতাইকারীদের ধরতে প্রতিনিয়তই অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় ছোট-বড় অন্তত অর্ধশত ছিনতাইকারী গ্রুপ রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে ৩ থেকে ৯ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব দলের ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে। এ ছাড়া দামি প্রাইভেট কার ব্যবহার করা ছিনতাইকারী চক্রও রয়েছে বেশ কয়েকটি। এদের মূল টার্গেট ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তি ও বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিং কর্মীরা। তা ছাড়া, বিদেশফেরত যাত্রী, ব্যবসায়ীও রয়েছে তাদের টার্গেটে। গত ২৬ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমণ্ডি ৭ নম্বর সড়কে টানা পার্টির প্রাইভেটকারের চাকায় মাথা থেঁতলে ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আয়া হেলেনা বেগম (৪০)। নিহতের পারিবারিক ও পুলিশ জানিয়েছে, হেলেনা রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের আয়া ছিলেন। স্বামীর সঙ্গে বরিশাল থেকে লঞ্চে ঢাকায় ফিরে সদরঘাটে নামেন শুক্রবার ভোর বেলা। সেখান থেকে বাসে ধানমণ্ডি ৭ নম্বরে নেমে রাস্তা পার হচ্ছিলেন তিনি। এ সময় একটি প্রাইভেট কার থেকে টানা পার্টির সদস্যরা হেলেনার হাতে থাকা ব্যাগটি টান দেয়। এতে বেসামাল হয়ে ওই প্রাইভেটকারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে রাস্তায় ছিটকে পড়েন তিনি। দুর্বৃত্তরা ওই অবস্থাতেই তার মাথার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে সংবাদ পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠায়। হেলেনার স্বামী মনিরুল ইসলাম মন্টু বলেন, তাঁর স্ত্রী গ্রিনলাইফ হাসপাতালের আয়া ছিলেন। তিনি নিজে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের টেকনিশিয়ান। তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে হেলেনার কর্মস্থলের কাছেই কলাবাগানে ১৬৮/২ নম্বর বাড়িতে থাকেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের দক্ষিণ কড়াপুর নবগ্রামে। জাতীয় পরিচয়ের স্মার্টকার্ড নিতে গত বুধবার স্বামী-স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। শুক্রবার তাঁরা লঞ্চে সদরঘাট নেমে সেখান থেকে ৭ নম্বর বাসে করে ধানমণ্ডির ৭ নম্বর রোডে মডার্ন হাসপাতাল ও ঢাকা ব্যাংকের কাছে নামেন ভোর ৫টায়। তখন বাইরে অনেকটা অন্ধকার। তাঁরা রাস্তা পার হয়ে রিকশায় বা হেঁটে বাসায় যাওয়ার চিন্তা করছিলেন। মন্টু বিলাপ করে বলেন, ও রাস্তায় নামলে ভয় পায়। মোর আত ধরে থাকে। বলে, ‘গাড়ি এসে যদি চাপ দেয়!’ মুই হাত ধরে পার হচ্ছিলাম। আমার হাত থেকে যমের হাতে চইলা গেল...।’ তিনি জানান, রাস্তার মাঝ বরাবর আসার পর পেছন দিক থেকে সাদা রঙের একটি টয়োটা প্রাইভেট কার আসে। ওই গাড়িটি তাঁদের বাঁ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চালক কাঁচ নামিয়ে হেলেনার ব্যাগ ধরে টান দেয়। তখন হেলেনার হাতে দুটি ব্যাগ ছিল। হেলেনার হাত গাড়ির সেই জানালায় আটকে যায়। চিৎকার করেন তিনি। মন্টুও চিৎকার করেন। প্রায় ২০ গজ দূরে যাওয়ার পর হেলেনা পড়ে যান। তখন গাড়িটির পেছনের চাকা হেলেনার মাথার ওপর দিয়ে যায়। মন্টু দৌড়ে স্ত্রীর কাছে গিয়ে আবারও চিৎকার করেন। পাশের ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরাও সাহায্য করতে এগিয়ে যাননি। রাস্তায় কোনো পুলিশও দেখেননি মন্টু। হেলেনার মাথা থেঁতলে রাস্তায় প্রায় মিলে যায়। রক্তে ভিজে যায় রাস্তা। ওই অবস্থায়ই স্ত্রীকে নিয়ে রাস্তায় বসে বিলাপ করছিলেন মন্টু। কয়েক মিনিট পরে পুলিশের গাড়ি পৌঁছায়। এরপর আশপাশের লোকজন হাজির হয়। মন্টু জানান, ছিনতাইকারীর সেই সাদা গাড়িতে চালকের বাঁ পাশে আরেকজন বসা ছিল। একই দিন সন্ধ্যায়ও হাজারীবাগে ছুরিকাহত হয়েছেন জাকির হোসেন নামে এক তরুণ। ওই সময় তাঁর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। আহত অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জাকিরের বাবা আবদুর রব বলেন, তাঁরা কামরাঙ্গীরচরে থাকেন। ইলেকট্রিক সামগ্রী মেরামতের কাজ শিখছেন জাকির। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তিনি রায়েরবাজার এলাকায় একজনের কাছ থেকে পাওনা ২০ হাজার টাকা নিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। পথে হাজারীবাগের জয়নুল হক শিকদার উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের পেছনে চার-পাঁচজন ছিনতাইকারী তাঁর পথরোধ করে। তারা জাকিরের কাঁধে ও পিঠে ছুরিকাঘাত করে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। ধানমণ্ডি থানার ওসি আব্দুল লতিফ এবং পরিদর্শক (তদন্ত) পারভেজ ইসলাম জানান, খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। ছিনতাইকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি এলাকায় পুলিশের টহল ছিল। সেখান থেকেই পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। ঘটনাস্থলের কাছে এক ভবনের নিরাপত্তাকর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘চিৎকার শুনে আমি এগিয়ে ঘটনা দেখেছি। তবে ভয়ে বের হইনি। এখানে প্রায়ই এমন ছিনতাই হয়। রাতে পুলিশ দুই-একবার গাড়ি নিয়ে ঘুরলেও ভোর ৪টার পরে ৭টা পর্যন্ত থাকে না। ৫টার দিকেই ছিনতাই বেশি হয়।’ ধানমণ্ডি এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, ধানমণ্ডি ৩ নম্বর, ৫ নম্বর, ৮ নম্বর, ৮ নম্বর (লেকের সড়ক), ঝিগাতলা, ১৫ নম্বর, আবহানী মাঠ ও শঙ্কর এলাকায় সাদা গাড়ি ও মোটরসাইকেলে টানা পার্টি সক্রিয়। গত ২ জানুয়ারি রাতে সেন্ট্রাল রোডের মাথায় ল্যাবএইড হাসপাতালের গণসংযোগ শাখার ব্যবস্থাপক মেজবাহ য়াযাদের ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয় একটি সাদা গাড়ি থেকে। আবুল কালাম নামে নিউ মার্কেটের চাদনী চকের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি দুইবার শিকার হয়েছি। মাঝেমধ্যে ভোরে আসতে হয়। বাস থেকে নামতেই ভয় লাগে। তবে সাহায্য চাওয়ার মতো পুলিশ দেখিনি।’ গত বছরের ২৯ নভেম্বর মিরপুর সড়কের কলেজ রোড সিগন্যাল থেকে রিকশা নিয়ে মোহাম্মদপুর যাওয়ার সময় আক্রান্ত হন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট (এনআইসিভিডি) ও হাসপাতালের চিকিৎসক ফরহাদ আলম। কাছেই শাহজাহান রোডে মোটরসাইকেলে আসা দুই ছিনতাইকারী ছোঁ মেরে তাঁর ব্যাগ নিয়ে যায়। এতে রাস্তায় ছিটকে পড়ে নিহত হন চিকিৎসক ফরহাদ। ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর ভোরে ধানমণ্ডির সোবহানবাগে মিরপুর রোডেই টানা পার্টির কবলে পড়ে শিশুসন্তান রাইসার সামনে প্রাণ হারান মা রিপা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপপরিদর্শক মারুফ হোসেন সরদার বলেন, বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই আশপাশের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহের কাজ শুরু করা হয়েছে। এ ছাড়া অপরাধীদের ধরতে অভিযানও শুরু করা হয়েছে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/আসাদ/হাসান/শাহনেওয়াজ